সালাম শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে নাবিহা, মাঈশা, কাশফিয়া, ইমামা আর মুবাশ্বারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো জাওয়াদ। সালামের জবাব দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আম্মাজানেরা আপনাদের এই অবস্থা কেন?
একদম অন্যরকম সাজগোজ করে পাঁচ কন্যা হাজির হয়েছিল জাওয়াদের কাছে। সবার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, চোখে চশমা, হাতে ডায়েরি, কলম এবং চেহারায় ছড়িয়ে থাকা কৌতুহল দেখে মনেহচ্ছিলো কোন নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার। অনেকটা রিপোর্টার স্টাইলেই মাঈশা বলল, গুড ইভিনিং স্যার। আমরা সবাই ‘নিজেকে গড়ো’ ম্যাগাজিনের তরফ থেকে আপনার ইন্টারভিউ নিতে এসেছি। দুঃখিত আমরা আগে থেকে আপনাকে ইনফর্ম করতে পারিনি। আসলে হঠাৎ করেই আমাদের চীফ এডিটর ম্যাম আপনার ইন্টারভিউ এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাশফিয়া বলল, জ্বি স্যার আমরা জানি আপনি খুবই ব্যস্ত একজন মানুষ। সেজন্য আমরা আবারো আন্তরিকতার সাথে ক্ষমা চাইছি। এবং আশা করছি আপনি আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছুটা সময় আমাদেরকে দেবেন।
নিত্যনতুন দুষ্টুমি বাড়ির বাচ্চাদের মস্তিষ্কে খেলা করতেই থাকে খুব ভালো করেই জানা আছে জাওয়াদের। বাচ্চারা যখন নতুন কোন দুষ্টুমির আয়োজন করে জাওয়াদ সবসময়ই চেষ্টা করে ওদেরকে সাপোর্ট করতে, সঙ্গ দিয়ে এবং সবার সাথে মিলে দুষ্টুমিটাকে উপভোগ করতে। বাচ্চাদের সাথে ওদের কোন আনন্দে শরিক হতে আসলে খুব বেশি করার প্রয়োজন হয়না কখনোই। একটু সময়, একটু মনোযোগের বিনিময়েই বাচ্চাদেরকে অনন্য সুন্দর স্মৃতি উপহার দেয়া সম্ভব হয়। আর বাচ্চাদেরকে এমন স্মৃতি উপহার দেয়ার ব্যাপারে জাওয়াদ যথাসাধ্য প্রস্তুত থাকে সবসময়ই। তাই চেহারা খানিকটা গম্ভীর টেনে এনে রাশ ভারি কন্ঠে বলল, আসলে সত্যি বলতে ইন্টারভিউ দেয়াটা আমার খুবই অপছন্দের একটি বিষয়। তারউপর এই মূহুর্তে যথেষ্ট ব্যস্ত আমি। সো আই এম রিয়েলি ভেরি সরি গাল’স।
ইমামা আবদারের কন্ঠে বলল, প্লিজ স্যার আমাদেরকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমরা আপনার খুব বেশি সময় নেবো না। অনলি থার্টি মিনিট’স। প্রমিস।
জাওয়াদ একটুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলল, ওকে বাট অনলি থার্টি মিনিট’স।
নাবিহা হেসে বলল, থ্যাঙ্কইউ সো মাচ। সময় নিয়ে আপনি কোন টেনশনই করবেন না স্যার। আমরা প্রতি মূহুর্তের মুভমেন্টের দিকে খেয়াল রাখবো। যাতে থার্টি মিনিটের একটুও এদিক সেদিক না হয়। আপনি কিছু মনে না করলে আমরা কি বসতে পারি?
শিওর। প্লিজ সীট।
বসার পর মুবাশ্বারা বলল, বেশ গরম আজ তাই না? আপনি চাইলে আমাদের সবার জন্য কোল কফি অর্ডার করতে পারেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই। এছাড়া চাইলে আমাদের সবার কোল কফিতে টু টেবিল স্পুন করে ভ্যানিলা আইসক্রিম এবং এক্সট্রা চকলেট দেবার কথাও বলতে পারেন।
হেসে ফেললো জাওয়াদ। এরপর উঠে মেয়েদের সবাইকে কোল কফি দেবার কথা বলে এসে বলল, তা হঠাৎ আপনার চীফ এডিটর ম্যাম আমার ইন্টারভিউ নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
মাঈশা বলল, আমাদের চীফ এডিটর ম্যাম অসাধারণ একজন মানুষ। একথায় উনার কথা বলতে গেলে বলতে হবে উনি জনকল্যাণে ব্র্যাক টাইপ মানুষ। বিশ্বস্ত সূত্রে ম্যাম জানতে পেরেছেন আপনি কিছু কোমলমনা মানুষদেরকে ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাদেরকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে মুক্তি দেবার উদ্দেশ্যেই আপনার ইন্টারভিউ প্ল্যান করা হয়েছে।
আমি কোমলমনা মানুষদের ঝুলিয়ে রেখেছি? কোথায়? কিভাবে? হাসি গোপন করে বিস্ময় মাখা কন্ঠে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।
কাশফিয়া জবাব দিলো, জ্বি স্যার বিশ্বস্ত সূত্র থেকে আমরা এই তথ্যই পেয়েছি। তথ্য ভুল হবার কোনই সম্ভাবনা নেই। কারণ সূত্র অতি বিশ্বস্ত।
আলহামদুলিল্লাহ আমি কখনোই কারো বিশ্বাসে আঘাত করিনা। কারো নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে তার সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো থেকেও সর্বদা দূরে থাকি। তাই আপনাদের বিশ্বস্ত সূত্র সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করতে চাইনা। তবে ঝুলন্ত কোমলমনা মানুষদের সম্পর্কে জানতে চাই। কেননা এই মূহুর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না কাদেরকে ঝুলিয়ে রেখেছি আমি।
নাবিহা বলল, ঘটনা হচ্ছে গিয়ে আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি কিছু মানুষ আপনার কাছে ভালোবাসা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল আজ থেকে প্রায় দেড় মাস আগে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আপনি তাদেরকে ভালোবাসার টিপস দেননি। শুধু তাই নয় মানুষগুলো কিছু প্রশ্নও করেছিল। সেসব প্রশ্নের জবাবও দেননি। আপনি মুঠো মুঠো ভালোবাসা ছড়ানোয় ব্রতী একজন মানুষ। আপনি জ্ঞান ও ভালোবাসার দ্বারা বিপ্লব সংঘটিত করে সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই আপনার কাছে এমন আচরণ আশা করিনি আমরা। মানুষ ভালোবাসা সম্পর্কে জানতে চাইছে, ভালোবাসা সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞানার্জন করে ভালোবাসতে চাইছে। আর আপনি কিনা ব্যস্ততার বাহানা বানিয়ে তাদের সবাইকে অপেক্ষারত রেখেছেন! আমাদের চীফ এডিটর ম্যাম আপনাকে উনার হিরো মানেন। আপনাকে নিজের মডেল, আইডল, রাহবার মনে করেন। তাই উনি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না আপনি কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করবেন। তাই এই ইন্টারভিউ।
জাওয়াদ হেসে বলল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আপনাদের চীফ এডিটর ম্যামকে উত্তম প্রতিদান দিন। কিন্তু আমি তো আরো বেশ কয়েকদিন আগেই আপনাদের চীফ এডিটর ম্যামকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম উনি যাতে সবার জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে দেন আমার হয়ে।
কিন্তু আমাদের ম্যাম আপনার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। প্রতিটা ফুলের রঙ, রূপ, সৌন্দর্য যেমন আলাদা আলাদা, প্রতিটা মানুষেরও তেমনি অন্যকে বোঝানোর ও বলার স্টাইল স্বতন্ত্র। ম্যাডাম তাই চান আপনার দায়িত্ব আপনিই পালন করুন। সবার প্রশ্নের জবাব আপনি নিজ মুখে দিন। সেজন্যই সবার প্রশ্ন নিয়ে আমরা আপনার কাছে এসেছি। এখন কি তাহলে আমরা আমাদের ইন্টারভিউ শুরু করতে পারি? প্রশ্ন করলো মুবাশ্বারা।
জাওয়াদ হেসে বলল, জ্বি অবশ্যই।
কাশফিয়া বলল, তবে মূল আলোচনায় যাবার আগে আমরা জানতে চাই মানুষের সম্পর্কের বন্ধনের এই যে জরাগ্রস্ত অবস্থা! এর মূল কারণটা আসলে কি? পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মনোমালিন্য, ভুল বোঝাবুঝি এসব থেকে একেবারে পরিত্রাণ পাবার কি কোনই পথ নেই? জন্মসূত্রে আমরা যে বন্ধনগুলোতে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসি। যেই সম্পর্কগুলোর তো সর্বদা আমাদের তরে ছায়াদানকারী, প্রশান্তিকর হওয়া উচিত ছিল। তাহলে কেন এতসব দ্বন্দ্ব?
জাওয়াদ বললে, কারণ হয়তো নিজেদের মূলের সাথে আমাদের বিচ্ছিন্নতা। শেকড় থেকে এতটা দুরুত্বে অবস্থান করা যারফলে শেকড়ের পক্ষে সম্ভব হয়না প্রাণ সঞ্জীবনী শক্তি পৌঁছে দেয়া। এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এত ছন্দপতন কারণ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। আপনারা নিশ্চয়ই স্কুলে বিভিন্ন সময়ে অনেক পরীক্ষা দিয়েছেন! পরীক্ষার হলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছেন কখনো? প্রাণপনে প্রতিটা স্টুডেন্ট লিখে চলে পরীক্ষায় পাশের আশায়। তাই না? অন্য কোন চিন্তা করার সুযোগ থাকে না তাদের। যাদের প্রশ্ন কমন পড়েনি তারাও বসে থাকে না চুপ করে। পাশ করতে হবে এই আশায় লিখার চেষ্টা জারি রাখে। এমন দুনিয়াটাকে একটি পরীক্ষা কেন্দ্র ভেবে সবাই যদি নিজ নিজ পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত থাকতো তাহলে দুনিয়া জুড়েও ঐ পরীক্ষা হলের মত পিনপতন নিরবতা এবং প্রশান্তি বজায় থাকতো। একটা সুন্দর লক্ষ্য যদি সব মানুষের মনে থাকতো এবং সেটা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী কাজ করতো! তাহলে হয়তো দুনিয়া জুড়ে বিরাজ করতো আরাধ্য মানবিকতা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, দয়া-মায়া-ভালোবাসা।
নাবিহা হাসিমুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আপনার চিন্তা, কথা সবসময়ই আমাদেরকে খুব মুগ্ধ করে। তাই খুব জানতে ইচ্ছে করে এত সুন্দর করে ভাবতে আপনি কখন, কোথায়, কার কাছে শিখেছেন।
জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। জীবন সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গী আমরা সবচেয়ে বেশি পেয়েছি আমাদের টিচার, গাইড, ফিলোসফার আবদুল্লাহ চাচাজান এবং আমাদের বাবার কাছ থেকে। বাবার শিক্ষাগুলো আমাদের মনের মাপকে বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেক গুণ। সবকিছুকে সহজ ভাবে গ্রহণ করতে শেখার শিক্ষাটাও বাবাই আমাদেরকে দিয়েছিলেন তাকদীরের জ্ঞানের দ্বারা। তাকদীর বিষয়টা আসলে কি সেটা যখন ঠিকমতো বুঝতেও শিখিনি, তখনও মানতে শিখে নিয়েছিলাম আমাদের সাথে যা কিছু সংঘটিত হয় তার মধ্যেই নির্ধারিত থাকে কল্ল্যাণ। তোমরা তো নিশ্চয়ই জানো অনেক ছোটবেলাতেই আমার মাথায় সায়েন্টিস্ট হবার শখ চেপে বসেছিল। আমি আতশী কাঁচের মতো একটা কাঁচ আবিষ্কার করার গবেষণা শুরু করেছিলাম। যার দ্বারা ঘটনার আড়ালে লুকায়িত কল্ল্যাণ সমূহকে দেখা যাবে।
মেয়েরা সবাই হেসে ফেললে জাওয়াদও সবার সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে বলল, বাবা আমার সেই গবেষণাতে কোনই বাঁধা দেননি। উল্টো উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন, এমন একটা কাঁচ আবিষ্কার করতে পারলে দারুন হতো। তুমি চেষ্টা চালিয়ে দাও। চেষ্টা করে করে আমি যখন একসময় সেটা বন্ধ করে নতুন গবেষণা শুরু করলাম। তখন একদিন বাবা আমাকে কোলে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলেন, ঘটমান সবকিছুর থেকে কল্ল্যাণকে খুঁজে নেবার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি কি জানো? সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া। যে কোন কিছু থেকে কল্ল্যাণ বের করে নেয়াটা সময় সাপেক্ষ কিন্তু চোখ মেলে ভালো ভাবে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যায় কোন না কোন শিক্ষা। যা জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। বাবার এই কথাটি এখনো পর্যন্ত আমার গাইড লাইন। আমার সাথে নেতিবাচক বা ইতিবাচক যাই কিছু ঘটুক না কেন, আমি তারমধ্যে থেকে কোন না কোন শিক্ষা তুলে নিতে পারি নিজের জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
ইমামা বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এখন থেকে তাহলে কথাটিকে আমরাও গাইড লাইন বানিয়ে নিলাম। আরো কিছু বলুন না প্লিজ আপনার বাবার সম্পর্কে।
জাওয়াদ হেসে বলল, আমরা যে সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখি বাবাই আমাদের দৃষ্টিসীমায় উন্মোচন করেছিলেন ভয়াবহ সুন্দর সেই জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রশান্ত কন্ঠে বলেছিলেন, জীবনটা আসলে ভীষণ রকম সুন্দর কিছু। আমরাই দৃষ্টির কমজোরির কারণে জীবনের সৌন্দর্য দেখতে ব্যর্থ হই এবং আমাদের চিন্তার নেতিবাচক প্রবাহে জীবনকে করে তুলি সমস্যামূখর, যাতনাকর, অসহনীয়। নানান ধরণের শর্ত, অনর্থক চাওয়া, অপ্রয়োজনীয় আশা, সীমালঙ্ঘন ইত্যাদির দ্বারা আমরা জীবনকে জটিল, কুটিল, কঠিন করে তুলি। আমরা জীবনকে জীবনের মতো না দেখে, নিজ ইচ্ছে ও শর্ত মোতাবেগ দেখতে চাই। জীবন আমাদের কাছে প্রাপ্তির কতশত আয়োজন নিয়ে এসেছে সেটা দেখেও না দেখার ভাণ করে, আমরা কি পেতে চাই সেই হিসাব নিয়ে বসে যাই। জীবনের প্রাণরস, জ্বালানি শক্তি, সৌন্দর্য জীবনকে ঘিরে আবর্তিত বন্ধন সমূহ। নিজ মতে, নিজ পথে অটল থাকতে গিয়ে সম্পর্কের বন্ধনও হয়ে দাঁড়ায় বিনিময়ের একটি মাধ্যম। কেউ যদি উত্তম ব্যবহার করে, তবেই বদলে তার সাথে উত্তম ব্যবহার করা হবে। কারো দ্বারা কষ্ট পাওয়া, উপকৃত না হওয়া মানে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। জীবন তো নয় যেন ম্যাথ বুক। ছক কাটা, গ্রাফ টানা, যোগ-বিয়োগ, গুণ, ভাগের হিসাব মেলাতেই সবাই ব্যস্ত। অথচ জীবনের আনন্দ, পূর্ণতা কিন্তু হিসাবের যথার্থতায় নয়।
তাহলে জীবনের পূর্ণতা কিসে? প্রশ্ন করলো কাশফিয়া।
জীবনের পূর্ণতা জীবনকে জীবনের মতো গ্রহণ করাতে। জীবনের পূর্ণতা চোখে আতশি কাচ লাগিয়ে প্রাপ্তি অনুসন্ধানে। ভুলের অনুশোচনায় নয় বরং সংশোধনের প্রচেষ্টায়। পূর্ণতা সংঘে, সৎ সংঘে। জীবনের লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে অবিচল থাকতে পারাতে। আপতিত পরীক্ষাগুলো খুব সহজ হয়ে যায় যদি জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। আর এই কথাটা খুব ছোটবেলায় বাবা আমাদেরকে বলেছিলেন। আমাদের প্রতিটি ক্ষুদ্র কর্মের পেছনে নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অবশ্যই থাকতো। আমরা খুব ছোটবেলাতেই গভীর ভাবে ভালোবাসতে শিখে নিয়েছিলাম পরস্পরকে। কারণ বাবা আমাদেরকে বলেছিলেন পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসায় উদ্দেশ্যে থাকা উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। লক্ষ্য যখন আল্লাহ থাকেন তখন স্বার্থপরতা প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয় ভাবেই। আমরা জানতান ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবো যেটা নিজের জন্য পছন্দের। এই জানাটা আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় ও মজবুতি দান করেছিল। আমাদের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক ছিল কোন কাজ যতই ছোট হোক কিংবা বড়। আমরা জানতাম কাজটা কেন করছি, বদলে কি পেতে যাচ্ছি এবং কাজটি করার সঠিক পদ্ধতিটাই বা কি! কেউ যখন আমাদেরকে আঘাত করতো, ঘৃণার পথ প্রশস্ত করতো সম্মুখে। আবদুল্লাহ চাচাজান বলতেন, খোঁজ খোঁজ এবং খুঁজলে অবশ্যই পাল্টা আঘাত না করার কোন না কোন কারণ পেয়ে যাবে। পেয়েই যাবে ঘৃণাকে ভালোবাসায় বদলে দেবার পথ। যাইহোক, আমরা মূল আলোচনাতে চলে যাই। তা না হলে থার্টি মিনিটস কম পড়ে যাবে।
নাবিহা হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে প্রশ্ন শুরু করি আমরা। যারা আপনার কাছে প্রশ্ন করেছেন উনারা সবাইই সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন। এবং সেই লক্ষ্য নিজ নিজ পরিবারকে আগে সুন্দর ও ভালোবাসাপূর্ণ করে গড়ে তুলতে চান। ১ম প্রশ্ন যিনি করেছেন তিনি জানতে চেয়েছেন, কাউকে যদি স্পেসিফিকভাবে চেনা যায় যে সুন্দর আচরণের পাশাপাশি স্বার্থের জন্য অন্যদের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করে না। সেক্ষেত্রে তাকে কিভাবে মোটিভেট উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্রের মানুষ হবার জন্য?
জাওয়াদ হেসে বলল, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে মনেহয়েছে যে কাউকে যে কোন ব্যাপারে মোটিভেট করার সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি হচ্ছে, মুখে না বলে কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া। সূরা আসরে যেমন আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে, সৎ কাজে উৎসাহ দিতে এবং অসৎ কাজে নিরুৎসাহিত করতে। বলা হয় অসাধ্যকে সাধন করার ক্ষমতা আছে উৎসাহের মধ্যে। ব্যক্তি জীবনে আমি নিজেও অসংখ্যবার এই কথাটিকে সত্য বলে প্রমাণিত পেয়েছি। ভালো কাজ করো, ভালো চিন্তা করো, সুন্দরের পথে চলো ইত্যাদি বলে চিৎকার করার চেয়ে। সত্য, সুন্দর ও আলোকিত জীবনের তরে মানুষকে উৎসাহিত করে তোলাটা খানিকটা সময় সাপেক্ষ হলেও বেশ ফলপ্রসূ। চলো তোমাদেরকে আমার স্টুডেন্ট লাইফের একটা ঘটনা বলি।
মেয়েরা সবাই হাসি মুখে বলল, জ্বি বলুন।
আমাদের এক ক্লাসমেট ছিল। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান বলে খুবই আদরের ছিল। নিজ সন্তান কিংবা পছন্দের যে কাউকেই সীমাহীন ভালোবাসারও কিছু সীমা থাকতে হয়। আইমিন, সীমা নির্ধারণ করে নেয়া উচিত। তা না হলে ভালোবাসার মতো সুন্দর ও পবিত্র কিছুও অনেক অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে জীবনে। আমাদের সেই ক্লাসমেটের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সীমাহীন ভালোবাসায় সঠিক পথের বাউন্ডারি পেরিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। বাবা-মার সাথে খুবই বাজে ব্যবহার করতো। আর কেউ তার বাবা-মাকে কষ্ট দিচ্ছে এই জিনিসটা আমি কখনোই সহ্য করতে পারিনা। সরাসরি ক্লাসমেটকে বললে আমার কথা শুনবে না জানতাম। তাই আমি খুব ধীরে এগিয়েছিলাম ওকে ওর ভুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। যখনই ওর সাথে কথা হতো প্রসঙ্গ টেনে আমি পরিবারের দিকে নিয়ে যেতাম। এরপর আমাদের পাপা, বাবাদের গল্প বলতাম, আমাদের জীবনে উনাদের ভালোবাসা, ত্যাগ ও অবদানের কথা বলতাম। ইচ্ছে করেই যখন আমার আশেপাশে থাকতো আমি পাপা, বাবাদের কাউকে ফোন করতাম। উনাদের খোঁজখবর নিতাম, উনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা বলতাম। আমার কথা, কাজ ও আচরণ সেই ক্লাসমেটকে বাধ্য করেছিল নিজের বাবা-মাকে নিয়ে ভাবতে। একটা সময় উপলব্ধি করেছিল ওর জীবন জুড়ে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও অবদান সমূহকে। এবং ধীরে ধীরে যত্নশীল হয়ে উঠেছিল ওর বাবা-মায়ের প্রতি। আসলে মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, নিজের নিয়ামত সমূহকে যথাযথ মূল্যায়ন না করা এবং নিজের বুঝটাকেই অগ্রাধিকার দেয়া। তাই সরাসরি কিছু বলতে চাইলে বেশিরভাগ মানুষই বিরোধিতার পথ বেছে নেয়। আমি তাই সরাসরি বলার চেয়ে মানুষকে উৎসাহিত করতে পছন্দ করি। তাই যদি এমন ডাবল পার্সোনালিটির কাউকে দেখি। যে ভালো কিন্তু নিজের স্বার্থের প্রশ্নে মন্দ হয়ে যেতে দ্বিধা করে না। আমি চেষ্টা করবো তাকে সর্বাবস্থায় এবং নিজ স্বার্থের প্রশ্নেও অন্যদের প্রতি কল্ল্যাণকামী থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে। এবং সেই চেষ্টা আমি করবো আমার নিজের উত্তম কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা। আর মানুষকে সুন্দরের পথে আকর্ষিত করে তোলার আরেকটি সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, তারমধ্যের উত্তম দিকগুলোকে সুন্দর করে তার সামনে উপস্থাপন করা। আমরা কাউকে শুধরানোর ক্ষেত্রে প্রথমেই যেই ভুলটা করি সেটা হচ্ছে, মন্দ কাজের জন্য তাকে তিরষ্কার করা। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে তার মনে এই বিশ্বাস জাগানো যে সে মূলত একজন উত্তম মানুষ। যদি কিছু ঘাতটি দূর করতে পারে তাহলে আরো উত্তম মানুষে পরিণত হতে পারবে। একটা ছোট শিশু প্রথম যেদিন পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজের বুকে আঁকাবাঁকা একটা দাগ টানে, তখন যদি তার সেই কর্মকে এপ্রিশিয়েট করা হয়। শিশুটি দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে পেন্সিল নিয়ে। কিন্তু তাকে যদি উৎসাহিত না করে বলা হয়, এটা কি এঁকেছো? আরো সুন্দর করে আঁকার চেষ্টা করো। তাহলে চেষ্টা হয়তো শিশুটি করবে কিন্তু তার মনে সেই আনন্দ, সেই স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে না। তাই যদি কারো অন্ধকার দূর করতে চাও তাহলে আগে তার সম্মুখে তার নিজস্ব আলোকময়তাকে উন্মোচন করে দাও। আলোয় সন্ধান দিয়ে অতঃপর অন্ধকার দেখিয়ে দিলে সে ইনশাআল্লাহ উৎসাহিত হবে নিজেকে আলোকিত করার লক্ষ্যে।
জাওয়াদের বলা কথাগুলো নোট করা শেষ করে নেক্সড প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো মাঈশা। কিন্তু সবার জন্য কোল কফি নিয়ে তখন আদী ঢুকলো। ইন্টারভিউতে সাময়িক বিরতি টেনে সবাই কফি পান করতে বসলো।