সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১৬

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...৫



সালাম শুনে দরজার দিকে তাকিয়ে নাবিহা, মাঈশা, কাশফিয়া, ইমামা আর মুবাশ্বারাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো জাওয়াদ। সালামের জবাব দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আম্মাজানেরা আপনাদের এই অবস্থা কেন?
একদম অন্যরকম সাজগোজ করে পাঁচ কন্যা হাজির হয়েছিল জাওয়াদের কাছে। সবার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, চোখে চশমা, হাতে ডায়েরি, কলম এবং চেহারায় ছড়িয়ে থাকা কৌতুহল দেখে মনেহচ্ছিলো কোন নিউজ চ্যানেলের রিপোর্টার। অনেকটা রিপোর্টার স্টাইলেই মাঈশা বলল, গুড ইভিনিং স্যার। আমরা সবাই ‘নিজেকে গড়ো’ ম্যাগাজিনের তরফ থেকে আপনার ইন্টারভিউ নিতে এসেছি। দুঃখিত আমরা আগে থেকে আপনাকে ইনফর্ম করতে পারিনি। আসলে হঠাৎ করেই আমাদের চীফ এডিটর ম্যাম আপনার ইন্টারভিউ এর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কাশফিয়া বলল, জ্বি স্যার আমরা জানি আপনি খুবই ব্যস্ত একজন মানুষ। সেজন্য আমরা আবারো আন্তরিকতার সাথে ক্ষমা চাইছি। এবং আশা করছি আপনি আপনার মূল্যবান সময় থেকে কিছুটা সময় আমাদেরকে দেবেন।
নিত্যনতুন দুষ্টুমি বাড়ির বাচ্চাদের মস্তিষ্কে খেলা করতেই থাকে খুব ভালো করেই জানা আছে জাওয়াদের। বাচ্চারা যখন নতুন কোন দুষ্টুমির আয়োজন করে জাওয়াদ সবসময়ই চেষ্টা করে ওদেরকে সাপোর্ট করতে, সঙ্গ দিয়ে এবং সবার সাথে মিলে দুষ্টুমিটাকে উপভোগ করতে। বাচ্চাদের সাথে ওদের কোন আনন্দে শরিক হতে আসলে খুব বেশি করার প্রয়োজন হয়না কখনোই। একটু সময়, একটু মনোযোগের বিনিময়েই বাচ্চাদেরকে অনন্য সুন্দর স্মৃতি উপহার দেয়া সম্ভব হয়। আর বাচ্চাদেরকে এমন স্মৃতি উপহার দেয়ার ব্যাপারে জাওয়াদ যথাসাধ্য প্রস্তুত থাকে সবসময়ই। তাই চেহারা খানিকটা গম্ভীর টেনে এনে রাশ ভারি কন্ঠে বলল, আসলে সত্যি বলতে ইন্টারভিউ দেয়াটা আমার খুবই অপছন্দের একটি বিষয়। তারউপর এই মূহুর্তে যথেষ্ট ব্যস্ত আমি। সো আই এম রিয়েলি ভেরি সরি গাল’স।
ইমামা আবদারের কন্ঠে বলল, প্লিজ স্যার আমাদেরকে ফিরিয়ে দেবেন না। আমরা আপনার খুব বেশি সময় নেবো না। অনলি থার্টি মিনিট’স। প্রমিস।
জাওয়াদ একটুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বলল, ওকে বাট অনলি থার্টি মিনিট’স।
নাবিহা হেসে বলল, থ্যাঙ্কইউ সো মাচ। সময় নিয়ে আপনি কোন টেনশনই করবেন না স্যার। আমরা প্রতি মূহুর্তের মুভমেন্টের দিকে খেয়াল রাখবো। যাতে থার্টি মিনিটের একটুও এদিক সেদিক না হয়। আপনি কিছু মনে না করলে আমরা কি বসতে পারি?
শিওর। প্লিজ সীট।
বসার পর মুবাশ্বারা বলল, বেশ গরম আজ তাই না? আপনি চাইলে আমাদের সবার জন্য কোল কফি অর্ডার করতে পারেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই। এছাড়া চাইলে আমাদের সবার কোল কফিতে টু টেবিল স্পুন করে ভ্যানিলা আইসক্রিম এবং এক্সট্রা চকলেট দেবার কথাও বলতে পারেন।
হেসে ফেললো জাওয়াদ। এরপর উঠে মেয়েদের সবাইকে কোল কফি দেবার কথা বলে এসে বলল, তা হঠাৎ আপনার চীফ এডিটর ম্যাম আমার ইন্টারভিউ নেবার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?
মাঈশা বলল, আমাদের চীফ এডিটর ম্যাম অসাধারণ একজন মানুষ। একথায় উনার কথা বলতে গেলে বলতে হবে উনি জনকল্যাণে ব্র্যাক টাইপ মানুষ। বিশ্বস্ত সূত্রে ম্যাম জানতে পেরেছেন আপনি কিছু কোমলমনা মানুষদেরকে ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাদেরকে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে মুক্তি দেবার উদ্দেশ্যেই আপনার ইন্টারভিউ প্ল্যান করা হয়েছে।
আমি কোমলমনা মানুষদের ঝুলিয়ে রেখেছি? কোথায়? কিভাবে? হাসি গোপন করে বিস্ময় মাখা কন্ঠে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।
কাশফিয়া জবাব দিলো, জ্বি স্যার বিশ্বস্ত সূত্র থেকে আমরা এই তথ্যই পেয়েছি। তথ্য ভুল হবার কোনই সম্ভাবনা নেই। কারণ সূত্র অতি বিশ্বস্ত।
আলহামদুলিল্লাহ আমি কখনোই কারো বিশ্বাসে আঘাত করিনা। কারো নিজস্ব বিশ্বাস নিয়ে তার সাথে দ্বন্দ্বে জড়ানো থেকেও সর্বদা দূরে থাকি। তাই আপনাদের বিশ্বস্ত সূত্র সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করতে চাইনা। তবে ঝুলন্ত কোমলমনা মানুষদের সম্পর্কে জানতে চাই। কেননা এই মূহুর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না কাদেরকে ঝুলিয়ে রেখেছি আমি।
নাবিহা বলল, ঘটনা হচ্ছে গিয়ে আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি কিছু মানুষ আপনার কাছে ভালোবাসা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল আজ থেকে প্রায় দেড় মাস আগে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আপনি তাদেরকে ভালোবাসার টিপস দেননি। শুধু তাই নয় মানুষগুলো কিছু প্রশ্নও করেছিল। সেসব প্রশ্নের জবাবও দেননি। আপনি মুঠো মুঠো ভালোবাসা ছড়ানোয় ব্রতী একজন মানুষ। আপনি জ্ঞান ও ভালোবাসার দ্বারা বিপ্লব সংঘটিত করে সুন্দর এক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন। সেই আপনার কাছে এমন আচরণ আশা করিনি আমরা। মানুষ ভালোবাসা সম্পর্কে জানতে চাইছে, ভালোবাসা সম্বন্ধে সঠিক জ্ঞানার্জন করে ভালোবাসতে চাইছে। আর আপনি কিনা ব্যস্ততার বাহানা বানিয়ে তাদের সবাইকে অপেক্ষারত রেখেছেন! আমাদের চীফ এডিটর ম্যাম আপনাকে উনার হিরো মানেন। আপনাকে নিজের মডেল, আইডল, রাহবার মনে করেন। তাই উনি এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না আপনি কথা দিয়ে কথার বরখেলাপ করবেন। তাই এই ইন্টারভিউ।
জাওয়াদ হেসে বলল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আপনাদের চীফ এডিটর ম্যামকে উত্তম প্রতিদান দিন। কিন্তু আমি তো আরো বেশ কয়েকদিন আগেই আপনাদের চীফ এডিটর ম্যামকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম উনি যাতে সবার জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে দেন আমার হয়ে।
কিন্তু আমাদের ম্যাম আপনার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে চাচ্ছেন না। প্রতিটা ফুলের রঙ, রূপ, সৌন্দর্য যেমন আলাদা আলাদা, প্রতিটা মানুষেরও তেমনি অন্যকে বোঝানোর ও বলার স্টাইল স্বতন্ত্র। ম্যাডাম তাই চান আপনার দায়িত্ব আপনিই পালন করুন। সবার প্রশ্নের জবাব আপনি নিজ মুখে দিন। সেজন্যই সবার প্রশ্ন নিয়ে আমরা আপনার কাছে এসেছি। এখন কি তাহলে আমরা আমাদের ইন্টারভিউ শুরু করতে পারি? প্রশ্ন করলো মুবাশ্বারা।
জাওয়াদ হেসে বলল, জ্বি অবশ্যই।
কাশফিয়া বলল, তবে মূল আলোচনায় যাবার আগে আমরা জানতে চাই মানুষের সম্পর্কের বন্ধনের এই যে জরাগ্রস্ত অবস্থা! এর মূল কারণটা আসলে কি? পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মনোমালিন্য, ভুল বোঝাবুঝি এসব থেকে একেবারে পরিত্রাণ পাবার কি কোনই পথ নেই? জন্মসূত্রে আমরা যে বন্ধনগুলোতে আবদ্ধ হয়ে পৃথিবীতে আসি। যেই সম্পর্কগুলোর তো সর্বদা আমাদের তরে ছায়াদানকারী, প্রশান্তিকর হওয়া উচিত ছিল। তাহলে কেন এতসব দ্বন্দ্ব?
জাওয়াদ বললে, কারণ হয়তো নিজেদের মূলের সাথে আমাদের বিচ্ছিন্নতা। শেকড় থেকে এতটা দুরুত্বে অবস্থান করা যারফলে শেকড়ের পক্ষে সম্ভব হয়না প্রাণ সঞ্জীবনী শক্তি পৌঁছে দেয়া। এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এত ছন্দপতন কারণ জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা। আপনারা নিশ্চয়ই স্কুলে বিভিন্ন সময়ে অনেক পরীক্ষা দিয়েছেন! পরীক্ষার হলের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছেন কখনো? প্রাণপনে প্রতিটা স্টুডেন্ট লিখে চলে পরীক্ষায় পাশের আশায়। তাই না? অন্য কোন চিন্তা করার সুযোগ থাকে না তাদের। যাদের প্রশ্ন কমন পড়েনি তারাও বসে থাকে না চুপ করে। পাশ করতে হবে এই আশায় লিখার চেষ্টা জারি রাখে। এমন দুনিয়াটাকে একটি পরীক্ষা কেন্দ্র ভেবে সবাই যদি নিজ নিজ পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত থাকতো তাহলে দুনিয়া জুড়েও ঐ পরীক্ষা হলের মত পিনপতন নিরবতা এবং প্রশান্তি বজায় থাকতো। একটা সুন্দর লক্ষ্য যদি সব মানুষের মনে থাকতো এবং সেটা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী কাজ করতো! তাহলে হয়তো দুনিয়া জুড়ে বিরাজ করতো আরাধ্য মানবিকতা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, দয়া-মায়া-ভালোবাসা।
নাবিহা হাসিমুখে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আপনার চিন্তা, কথা সবসময়ই আমাদেরকে খুব মুগ্ধ করে। তাই খুব জানতে ইচ্ছে করে এত সুন্দর করে ভাবতে আপনি কখন, কোথায়, কার কাছে শিখেছেন।
জাওয়াদ হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। জীবন সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গী আমরা সবচেয়ে বেশি পেয়েছি আমাদের টিচার, গাইড, ফিলোসফার আবদুল্লাহ চাচাজান এবং আমাদের বাবার কাছ থেকে। বাবার শিক্ষাগুলো আমাদের মনের মাপকে বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেক গুণ। সবকিছুকে সহজ ভাবে গ্রহণ করতে শেখার শিক্ষাটাও বাবাই আমাদেরকে দিয়েছিলেন তাকদীরের জ্ঞানের দ্বারা। তাকদীর বিষয়টা আসলে কি সেটা যখন ঠিকমতো বুঝতেও শিখিনি, তখনও মানতে শিখে নিয়েছিলাম আমাদের সাথে যা কিছু সংঘটিত হয় তার মধ্যেই নির্ধারিত থাকে কল্ল্যাণ। তোমরা তো নিশ্চয়ই জানো অনেক ছোটবেলাতেই আমার মাথায় সায়েন্টিস্ট হবার শখ চেপে বসেছিল। আমি আতশী কাঁচের মতো একটা কাঁচ আবিষ্কার করার গবেষণা শুরু করেছিলাম। যার দ্বারা ঘটনার আড়ালে লুকায়িত কল্ল্যাণ সমূহকে দেখা যাবে।
মেয়েরা সবাই হেসে ফেললে জাওয়াদও সবার সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে বলল, বাবা আমার সেই গবেষণাতে কোনই বাঁধা দেননি। উল্টো উৎসাহ দিয়েছেন। বলেছেন, এমন একটা কাঁচ আবিষ্কার করতে পারলে দারুন হতো। তুমি চেষ্টা চালিয়ে দাও। চেষ্টা করে করে আমি যখন একসময় সেটা বন্ধ করে নতুন গবেষণা শুরু করলাম। তখন একদিন বাবা আমাকে কোলে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলেন, ঘটমান সবকিছুর থেকে কল্ল্যাণকে খুঁজে নেবার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি কি জানো? সেই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়া। যে কোন কিছু থেকে কল্ল্যাণ বের করে নেয়াটা সময় সাপেক্ষ কিন্তু চোখ মেলে ভালো ভাবে তাকালেই খুঁজে পাওয়া যায় কোন না কোন শিক্ষা। যা জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। বাবার এই কথাটি এখনো পর্যন্ত আমার গাইড লাইন। আমার সাথে নেতিবাচক বা ইতিবাচক যাই কিছু ঘটুক না কেন, আমি তারমধ্যে থেকে কোন না কোন শিক্ষা তুলে নিতে পারি নিজের জন্য আলহামদুলিল্লাহ।
ইমামা বলল, আলহামদুলিল্লাহ। এখন থেকে তাহলে কথাটিকে আমরাও গাইড লাইন বানিয়ে নিলাম। আরো কিছু বলুন না প্লিজ আপনার বাবার সম্পর্কে।
জাওয়াদ হেসে বলল, আমরা যে সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখি বাবাই আমাদের দৃষ্টিসীমায় উন্মোচন করেছিলেন ভয়াবহ সুন্দর সেই জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রশান্ত কন্ঠে বলেছিলেন, জীবনটা আসলে ভীষণ রকম সুন্দর কিছু। আমরাই দৃষ্টির কমজোরির কারণে জীবনের সৌন্দর্য দেখতে ব্যর্থ হই এবং আমাদের চিন্তার নেতিবাচক প্রবাহে জীবনকে করে তুলি সমস্যামূখর, যাতনাকর, অসহনীয়। নানান ধরণের শর্ত, অনর্থক চাওয়া, অপ্রয়োজনীয় আশা, সীমালঙ্ঘন ইত্যাদির দ্বারা আমরা জীবনকে জটিল, কুটিল, কঠিন করে তুলি। আমরা জীবনকে জীবনের মতো না দেখে, নিজ ইচ্ছে ও শর্ত মোতাবেগ দেখতে চাই। জীবন আমাদের কাছে প্রাপ্তির কতশত আয়োজন নিয়ে এসেছে সেটা দেখেও না দেখার ভাণ করে, আমরা কি পেতে চাই সেই হিসাব নিয়ে বসে যাই। জীবনের প্রাণরস, জ্বালানি শক্তি, সৌন্দর্য জীবনকে ঘিরে আবর্তিত বন্ধন সমূহ। নিজ মতে, নিজ পথে অটল থাকতে গিয়ে সম্পর্কের বন্ধনও হয়ে দাঁড়ায় বিনিময়ের একটি মাধ্যম। কেউ যদি উত্তম ব্যবহার করে, তবেই বদলে তার সাথে উত্তম ব্যবহার করা হবে। কারো দ্বারা কষ্ট পাওয়া, উপকৃত না হওয়া মানে তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া। জীবন তো নয় যেন ম্যাথ বুক। ছক কাটা, গ্রাফ টানা, যোগ-বিয়োগ, গুণ, ভাগের হিসাব মেলাতেই সবাই ব্যস্ত। অথচ জীবনের আনন্দ, পূর্ণতা কিন্তু হিসাবের যথার্থতায় নয়।
তাহলে জীবনের পূর্ণতা কিসে? প্রশ্ন করলো কাশফিয়া।
জীবনের পূর্ণতা জীবনকে জীবনের মতো গ্রহণ করাতে। জীবনের পূর্ণতা চোখে আতশি কাচ লাগিয়ে প্রাপ্তি অনুসন্ধানে। ভুলের অনুশোচনায় নয় বরং সংশোধনের প্রচেষ্টায়। পূর্ণতা সংঘে, সৎ সংঘে। জীবনের লক্ষ্য হাসিলের উদ্দেশ্যে অবিচল থাকতে পারাতে। আপতিত পরীক্ষাগুলো খুব সহজ হয়ে যায় যদি জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। আর এই কথাটা খুব ছোটবেলায় বাবা আমাদেরকে বলেছিলেন। আমাদের প্রতিটি ক্ষুদ্র কর্মের পেছনে নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে অবশ্যই থাকতো। আমরা খুব ছোটবেলাতেই গভীর ভাবে ভালোবাসতে শিখে নিয়েছিলাম পরস্পরকে। কারণ বাবা আমাদেরকে বলেছিলেন পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসায় উদ্দেশ্যে থাকা উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। লক্ষ্য যখন আল্লাহ থাকেন তখন স্বার্থপরতা প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয় ভাবেই। আমরা জানতান ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভাইয়ের জন্য সেটাই পছন্দ করবো যেটা নিজের জন্য পছন্দের। এই জানাটা আমাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় ও মজবুতি দান করেছিল। আমাদের সবচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক ছিল কোন কাজ যতই ছোট হোক কিংবা বড়। আমরা জানতাম কাজটা কেন করছি, বদলে কি পেতে যাচ্ছি এবং কাজটি করার সঠিক পদ্ধতিটাই বা কি! কেউ যখন আমাদেরকে আঘাত করতো, ঘৃণার পথ প্রশস্ত করতো সম্মুখে। আবদুল্লাহ চাচাজান বলতেন, খোঁজ খোঁজ এবং খুঁজলে অবশ্যই পাল্টা আঘাত না করার কোন না কোন কারণ পেয়ে যাবে। পেয়েই যাবে ঘৃণাকে ভালোবাসায় বদলে দেবার পথ। যাইহোক, আমরা মূল আলোচনাতে চলে যাই। তা না হলে থার্টি মিনিটস কম পড়ে যাবে।
নাবিহা হেসে বলল, আচ্ছা তাহলে প্রশ্ন শুরু করি আমরা। যারা আপনার কাছে প্রশ্ন করেছেন উনারা সবাইই সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেন। এবং সেই লক্ষ্য নিজ নিজ পরিবারকে আগে সুন্দর ও ভালোবাসাপূর্ণ করে গড়ে তুলতে চান। ১ম প্রশ্ন যিনি করেছেন তিনি জানতে চেয়েছেন, কাউকে যদি স্পেসিফিকভাবে চেনা যায় যে সুন্দর আচরণের পাশাপাশি স্বার্থের জন্য অন্যদের ক্ষতি করতেও দ্বিধা করে না। সেক্ষেত্রে তাকে কিভাবে মোটিভেট উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ চরিত্রের মানুষ হবার জন্য?
জাওয়াদ হেসে বলল, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে মনেহয়েছে যে কাউকে যে কোন ব্যাপারে মোটিভেট করার সবচেয়ে সহজ ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি হচ্ছে, মুখে না বলে কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয়া। সূরা আসরে যেমন আমাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে, সৎ কাজে উৎসাহ দিতে এবং অসৎ কাজে নিরুৎসাহিত করতে। বলা হয় অসাধ্যকে সাধন করার ক্ষমতা আছে উৎসাহের মধ্যে। ব্যক্তি জীবনে আমি নিজেও অসংখ্যবার এই কথাটিকে সত্য বলে প্রমাণিত পেয়েছি। ভালো কাজ করো, ভালো চিন্তা করো, সুন্দরের পথে চলো ইত্যাদি বলে চিৎকার করার চেয়ে। সত্য, সুন্দর ও আলোকিত জীবনের তরে মানুষকে উৎসাহিত করে তোলাটা খানিকটা সময় সাপেক্ষ হলেও বেশ ফলপ্রসূ। চলো তোমাদেরকে আমার স্টুডেন্ট লাইফের একটা ঘটনা বলি।
মেয়েরা সবাই হাসি মুখে বলল, জ্বি বলুন।
আমাদের এক ক্লাসমেট ছিল। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান বলে খুবই আদরের ছিল। নিজ সন্তান কিংবা পছন্দের যে কাউকেই সীমাহীন ভালোবাসারও কিছু সীমা থাকতে হয়। আইমিন, সীমা নির্ধারণ করে নেয়া উচিত। তা না হলে ভালোবাসার মতো সুন্দর ও পবিত্র কিছুও অনেক অকল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে জীবনে। আমাদের সেই ক্লাসমেটের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। সীমাহীন ভালোবাসায় সঠিক পথের বাউন্ডারি পেরিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। বাবা-মার সাথে খুবই বাজে ব্যবহার করতো। আর কেউ তার বাবা-মাকে কষ্ট দিচ্ছে এই জিনিসটা আমি কখনোই সহ্য করতে পারিনা। সরাসরি ক্লাসমেটকে বললে আমার কথা শুনবে না জানতাম। তাই আমি খুব ধীরে এগিয়েছিলাম ওকে ওর ভুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। যখনই ওর সাথে কথা হতো প্রসঙ্গ টেনে আমি পরিবারের দিকে নিয়ে যেতাম। এরপর আমাদের পাপা, বাবাদের গল্প বলতাম, আমাদের জীবনে উনাদের ভালোবাসা, ত্যাগ ও অবদানের কথা বলতাম। ইচ্ছে করেই যখন আমার আশেপাশে থাকতো আমি পাপা, বাবাদের কাউকে ফোন করতাম। উনাদের খোঁজখবর নিতাম, উনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কথা বলতাম। আমার কথা, কাজ ও আচরণ সেই ক্লাসমেটকে বাধ্য করেছিল নিজের বাবা-মাকে নিয়ে ভাবতে। একটা সময় উপলব্ধি করেছিল ওর জীবন জুড়ে বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও অবদান সমূহকে। এবং ধীরে ধীরে যত্নশীল হয়ে উঠেছিল ওর বাবা-মায়ের প্রতি। আসলে মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে, নিজের নিয়ামত সমূহকে যথাযথ মূল্যায়ন না করা এবং নিজের বুঝটাকেই অগ্রাধিকার দেয়া। তাই সরাসরি কিছু বলতে চাইলে বেশিরভাগ মানুষই বিরোধিতার পথ বেছে নেয়। আমি তাই সরাসরি বলার চেয়ে মানুষকে উৎসাহিত করতে পছন্দ করি। তাই যদি এমন ডাবল পার্সোনালিটির কাউকে দেখি। যে ভালো কিন্তু নিজের স্বার্থের প্রশ্নে মন্দ হয়ে যেতে দ্বিধা করে না। আমি চেষ্টা করবো তাকে সর্বাবস্থায় এবং নিজ স্বার্থের প্রশ্নেও অন্যদের প্রতি কল্ল্যাণকামী থাকার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে। এবং সেই চেষ্টা আমি করবো আমার নিজের উত্তম কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা। আর মানুষকে সুন্দরের পথে আকর্ষিত করে তোলার আরেকটি সহজ পদ্ধতি হচ্ছে, তারমধ্যের উত্তম দিকগুলোকে সুন্দর করে তার সামনে উপস্থাপন করা। আমরা কাউকে শুধরানোর ক্ষেত্রে প্রথমেই যেই ভুলটা করি সেটা হচ্ছে, মন্দ কাজের জন্য তাকে তিরষ্কার করা। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে তার মনে এই বিশ্বাস জাগানো যে সে মূলত একজন উত্তম মানুষ। যদি কিছু ঘাতটি দূর করতে পারে তাহলে আরো উত্তম মানুষে পরিণত হতে পারবে। একটা ছোট শিশু প্রথম যেদিন পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজের বুকে আঁকাবাঁকা একটা দাগ টানে, তখন যদি তার সেই কর্মকে এপ্রিশিয়েট করা হয়। শিশুটি দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে পেন্সিল নিয়ে। কিন্তু তাকে যদি উৎসাহিত না করে বলা হয়, এটা কি এঁকেছো? আরো সুন্দর করে আঁকার চেষ্টা করো। তাহলে চেষ্টা হয়তো শিশুটি করবে কিন্তু তার মনে সেই আনন্দ, সেই স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে না। তাই যদি কারো অন্ধকার দূর করতে চাও তাহলে আগে তার সম্মুখে তার নিজস্ব আলোকময়তাকে উন্মোচন করে দাও। আলোয় সন্ধান দিয়ে অতঃপর অন্ধকার দেখিয়ে দিলে সে ইনশাআল্লাহ উৎসাহিত হবে নিজেকে আলোকিত করার লক্ষ্যে।
জাওয়াদের বলা কথাগুলো নোট করা শেষ করে নেক্সড প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলো মাঈশা। কিন্তু সবার জন্য কোল কফি নিয়ে তখন আদী ঢুকলো। ইন্টারভিউতে সাময়িক বিরতি টেনে সবাই কফি পান করতে বসলো।

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...৪



আমিও চলে এসেছি আপ্পা চা বানানো শেখার জন্য। 
বিকেলের নাস্তা দেবার পর সবার জন্য চা বানাতে এসেছিল নূহা। কথা শুনে রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে সুমাইয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নূহা হেসে বলল, ভেতরে এসো। 
ভেতরে ঢুকে সুমাইয়া বলল, চা বানানোর সাথে সাথে আমাকে আরেকটা জিনিসও শিখিয়ে দিতে হবে।
নূহা হেসে বলল, কি জিনিস?
নিজের ভুলগুলোকে খুব সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেয়াটা। নিজের দোষ, অন্যায়গুলো অকপটে স্বীকার করে নেয়া। শুধু আমি না আপ্পা আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যরই এই একটাই সমস্যা। আমরা কেউ কারো কাছে হার মানতে চাই না। আব্বু আম্মুর মধ্যে এই সমস্যাটা খুবই জোরালো ভাবে আছে। আমাদের ভাইবোনদের মধ্যেও। একটা সময় আমি বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝি অনেক কিছুই করি, বলি যা আসলে ঠিক না। কিন্তু কেন জানি এটা সবার সামনে মেনে নিতে পারিনা। আগে তো নিজের কাছেও মেনে নিতে পারতাম না। আলহামদুলিল্লাহ এখন অন্তত নিজের ভুলটা বুঝতে পারি। এই অবস্থা থেকে কিভাবে মুক্তি পেতে পারি সেটা বলে দিতে হবে আমাকে।
সত্যিই এটা অনেক বড় একটা সমস্যা। নিজেকে অন্যের কাছে সর্বদা সঠিক রাখতে চাওয়ার পেছনে মূলত ইগো কাজ করে। আর সম্পর্কের বন্ধনের চেয়ে যখন ইগো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মানুষের কাছে তখন ভালোবাসার শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। যারফলে, খুব ভালোবাসার দাবী করে যাকে তাকেও মানুষ আঘাত করতে পারে নির্দ্বিধায়।
সুমাইয়া বলল, আমিও আজকাল এমনটাই মনেহ্য় আপ্পা। সেজন্যই এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই।
নূহা হেসে বলল, মুখ আর মুখোশের যে পার্থক্যের কথাটা বলা হয় সেটা মূলত বলা হয় অন্যদের সাথে আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু মুখ ও মুখোশের এই যে আবডাল এটা কিন্তু ব্যক্তির নিজের সাথেও বিদ্যমান থাকে অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন নিজের কোন দোষ কিংবা বদভ্যাস জানা থাকার পরেও জোর করে অজ্ঞাত সেজে থাকা। কিছুতেই নিজের কোন ঘাটতিকে স্বীকার করতে না চাওয়া। নিজের সাথে এই যে আড়াল, এই যে লুকোচুরি এরফলেও মনের ঘরে বাসা বাঁধে নানান ধরণের মানসিক অস্থিরতা, দোটানা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব,দোদুল্যমনতার। মুখ আর মুখোশের ব্যবধান ঘুচিয়ে কিভাবে একজন ব্যক্তি সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে সেই সম্পর্কে জানতে গিয়েই জেনেছিলাম সেলফ হিপনোটিজম পদ্ধতি সম্বন্ধে। বিষণ্ণতার মেঘকে উড়িয়ে মনের বিষাদ কাটিয়ে বিশ্বাসের সূর্য থেকে নিঃসৃত আশার কিরণে কিভাবে নতুন করে সম্মুখে এগিয়ে চলার উৎসাহ পাওয়া যায় সেই ফমূর্লাই হচ্ছে সেলফ হিপনোটিজম। মূলত আমাদের হতাশা, নিরাশা, দুরাশা, হাল ছেড়ে দেয়া, নিস্তেজ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নেতিবাচক আচরণ সমূহের আসল কারণ আমরা নিজেদের নিয়ে একদমই ভাবিনা। অথচ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করাটা খুব বেশি জরুরী। আত্মবিশ্লেষণ, আত্নপর্যালোচনা, আত্নসমালোচনা ব্যক্তিকে শুধু যে উন্নতির দিকে ধাবিত হতেই সহায়তা করে তাই নয়। ব্যক্তির সামনে উন্মোচন করে তার নিজেকে, তার আপনার আমিকে। আমরা প্রায় সময়ই নিজের কোন কথা-কাজ বা আচরণের পেছনে কোন রিজন বা লজিক খুঁজে পাইনা। অন্যদের সাথে সাথে নিজেরাও হয়রান, পেরেশান হই নিজের কর্মকান্ডে। এর কারণ নিজের সম্পর্কে অজ্ঞতা। নিজের চিন্তা ও কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজের সম্পর্কে জানা। আবার জানতে হলে নিজেকে বুঝতে হবে এবং বুঝতে হলে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হবে। কেননা নিজেকে নিয়ে ভাবলেই নিজের মুখোমুখি হওয়া যায়।
জ্বি আপ্পা। যখন থেকে নিজেকে নিয়ে খুব গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করেছি তখন থেকেই মূলত নিজের এই সমস্ত দোষগুলো কিছুটা হলেও বুঝতে শুরু করেছি।
সেজন্যই আমি সবসময়ই তোমাদেরকে বলি নিজেকে সময় দেবার কথা। নিজের মাঝে নিজেকে খুঁজে ফেরার কথা। আপনও আঁধার কোথায়, আলো কোথায় সেই জ্ঞান রাখার কথা। আসলে প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু ভালো এবং কিছু মন্দ দিক আছে। নিজের উত্তম গুণাবলী সম্পর্কে ভাবনা মানুষকে আনন্দিত করে, উৎসাহিত করে। অপরদিকে নিজের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটি-ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবলে নিজেকে সংশোধন করার ইচ্ছে জাগ্রত হয়। প্রতিটা মানুষের মধ্যেই নিজেকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার শক্তি আছে। এক টুকরো আলো আছে মনের কোনে ঘোর আঁধারে পথ প্রদর্শনের জন্য। তেমনি আছে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে যাবার মতো দুর্বলতা, আছে আশার টিমটিমে বাতিটাকে পুরোপুরি নিভিয়ে দেবার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন বাতাস। তাই অবশ্যই জানা থাকা উচিত কোথায় নিজের শক্তি আর কোথায় নিজের দুর্বলতা ।নিজের সম্পর্কে যথাযথ ধারণা থাকলে মানুষ থেকে উত্তম মানুষ হবার সফর খুব সহজেই পাড়ি দেয়া সম্ভব হয়। এজন্য দরকার নিজের কাছে নিজের মুখোশ উন্মোচন করে, নিজেই নিজের আয়না হবার। তবে বিষয়টা খানিকটা কঠিন বৈকি! কেননা আমাদের মনের ভেতরটাকে বলা যায় হাজারো চিন্তা-ভাবনার এক বিশাল কারখানা। যেখানে চেতন, অবচেতন, অচেতন সর্বাবস্থাতেই সর্বক্ষণই উৎপন্ন হতে থাকে নানামুখী চিন্তার স্রোত এবং প্রবাহিত হয় নানান দিকে। আবেগের মহাবিশৃংখলা, প্রতিকুল অবস্থা-অবস্থান, পরিবেশ-পরিস্থিতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাবে চারিত্রিক নানান দূর্বলতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সুন্দর জীবন গড়ার পথে। ইগোর গোলকধাঁধা, স্বার্থপরতার চোরাবালি, প্রতিহিংসার দহন, পরশ্রীকাতরতার গুপ্তঘাতক ইত্যাদি ঘুণপোকার মতে কুড়ে কুড়ে খায় মনের কোমলতা, সরলতা, উচ্ছ্বাস, বিশ্বাস, আশা, ভালোবাসাকে। মানুষ হয়ে যেতে থাকে সুন্দর আবেগ বিবর্জিত যন্ত্র এবং অসুন্দর আবেগ চালিত অনুভূতিহীন প্রাণী। নিজেই নিজের ধরা ছোঁয়ার বাইরের কেউ। নিজেকে খুঁজে পেতে, ছুঁয়ে দিতে হিপনোটিক সাজেশন পালন করতে পারে সহায়ক ভূমিকা।
কিভাবে করতে হয় সেলফ হিপনোটিজম?
নূহা হেসে বলল, বলবো। তবে তারআগে মজার একটা ঘটনা বলি তোমাকে। আমার এক ফ্রেন্ড একদিন নীচু গলায় লাজুক কন্ঠে বলল, আমার একটা বিরাট সমস্যা আছে। কিভাবে যে দূর করবো ভেবে পাচ্ছি না। সমস্যাটা কি জানতে চাইলে সে বললো, গল্প-উপন্যাস, নাটক-মুভি যাই কিছু পড়তে বা দেখতে যায় ইমোশনাল দৃশ্যপটে কিছুতেই অশ্রু সংবরণ করতে পারে না। এটা নিয়ে প্রায়ই লজ্জিত হতে হয় পরিজন ও বন্ধুমহলে। ইমোশনাল দৃশ্য এলে সবাই টিভির স্ক্রিনের বদলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে বিনোদন নেবার উদ্দেশ্যে। ফ্রেন্ডের গুরুতর এই সমস্যার কথা শুনে হাসি চাপতে বেশ কষ্ট হয়েছিল। কেননা আমি নিজেও সেই ফ্রেন্ডের কথায় কথায় কেঁদে অস্থির হয়ে যাওয়াটা দেখে বেশ মজা পেতাম। যদিও এমনটা কম-বেশি প্রায় সব মানুষের সাথেই হয়। ইমোশনাল কথা পড়ে, দৃশ্য দেখে কাল্পনিক জানা থাকার পরেও আমাদের বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আসে, চোখ ভিজে ওঠে।
সুমাইয়া হেসে বলল, হ্যা এটা তো আমারও হয়। গল্প উপন্যাস পড়ার সময় ইমোশনাল কিছু থাকলে আমার চোখের নল অটোমেটিক অন হয়ে যায়।
নূহা হেসে বলল, কখনো কি ভেবে দেখেছো এর কারণ কি? কেন এমনটা হয় যেখানে স্পষ্ট জানাই থাকে আমি যা দেখছি বা পড়ছি তা মোটেই বাস্তব কিছু নয়! এর কারণ আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। বাস্তব কোন ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের ব্রেইনে যে ওয়েভ তৈরি করে, কাল্পনিক ঘটনার ক্ষেত্রেও একই ওয়েভ তৈরি হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমার কথা। যেখানে পরিষ্কার জানা থাকে এটা অভিনয় কিন্তু তারপরও আমরা সেই অভিনীত দৃশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে কখনো হাসি, কখনো কাঁদি। এমনকি কারো প্রতি হই ঈর্ষানীত্ব, কারো প্রতি প্রতিশোধপরায়ন। নায়ক যখন ভিলেনকে হারিয়ে দেয় আমরা ছোট শিশুর মতোই উচ্ছ্বাসিত হই। নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদে হই ভারাক্রান্ত, তাদের মিলনে হই আবেগঘন, চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠে আনন্দ্রাশ্রু। চিন্তা করলে এই বিষয়গুলো সত্যিই বিস্ময় জাগায় মনে। এত বুদ্ধিমান প্রাণী হবার পরেও মানুষ কেন কল্পনার স্রোতে ভেসে যায়? কেন পারে না বাস্তবতার সাথে প্রভেদ নির্ণয় করতে?!
কেন পারে না আপ্পা?
কারণ আগেই বলেছি আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। আমরা যদিও বা কোন গল্পের বই পড়ছি কিংবা অভিনীত দৃশ্য দেখছি। কিন্তু আমাদের নার্ভাস সিস্টেম মোটেই সেটাকে অভিনয় বা গল্প মনে করছে না। সে এটাকে বাস্তব ধরে নিচ্ছে এবং আমাদেরকে রিয়েল ইমোশন সাপ্লাই দিচ্ছে। যারফলে আমরা ঠিক তাই করি যা ঘটনাটা বাস্তবে ঘটলে করতাম। আমাদের নার্ভাস সিস্টেমের এই যে বৈশিষ্ট্য এটা কিন্তু আমাদের জন্য বিরাট একটা প্রাপ্তি। নিজেকে লক্ষ্যানুযায়ী পরিচালিত করার পথে বিরাট এক অস্ত্রও বলা যায়। যখন নেতিবাচকতায় ছেয়ে যায় আমাদের জীবন। এবং তার প্রভাবে প্রভানিত্ব হই আমরা। বিষণ্ণতা, হতাশা ঘিরে ধরতে চায় আমাদের মনকে। তখন আমরা চাইলেই পারি আমাদের আমাদের নার্ভাস সিস্টেম থেকে পজেটিভ ফিডব্যাক আদায় করে নিয়ে আশার দিয়া জ্বালাতে।
সেটা কিভাবে?
বলছি তবে তারআগে আরেকবার মনে করে দেই শব্দের শক্তির কথা। শব্দে লুকায়িত প্রাণের অস্তিত্বের কথা। অনেকেই জানেন না 'শব্দে লুকায়িত আছে শক্তি, শব্দ দিতে পারে মুক্তি, শব্দ জাগায় ভক্তি, শব্দ আনে তৃপ্তি। শব্দ করে হতাশ, শব্দই সুবাসিত বাতাস, শব্দ ছোঁয়ায় আকাশ, শব্দে গভীর দীর্ঘশ্বাস'। শব্দ বা কথা খুবই শক্তিশালী। শব্দের আছে ভয়াবহ সৃষ্টিশীল ক্ষমতা। শব্দ কিন্তু শুধু কোন কিছু উপস্থাপনই করে না, একই সাথে শব্দ সেইসব কিছুকে মনে স্থাপনও করে, মস্তিষ্কে নির্মাণও করে। উদাহরণ স্বরূপ খাবারের কথা বলা যায়। কেউ যদি আমাদের সামনে আমাদের খুব পছন্দনীয় কোন খাবারের কথা বলে, আমাদের চোখের সামনে সেই খাবারটার ইমেজ ভেসে ওঠে। আবার টক জাতীয় কোন খাবারের নাম শুনলেই মুখে লালা চলে আসে। কারো মুখে তার বেদনার কথা শুনলেই আমাদের মনে সহানুভূতি জেগে ওঠে। এইসব কিছুই প্রমাণ করে শব্দ শুধু কোন কিছুর বিবরণই দেয় না বরং সেই বস্তুর ইমেজ তৈরি করারও ক্ষমতা রাখে। সেলফ হিপনোটিজম পদ্ধতিতে শব্দের এই ইতিবাচক ক্ষমতাটিই ব্যবহৃত হয়। আমাদের নার্ভাস সিস্টেম কল্পনা ও বাস্তবতার পার্থক্য বোঝে না এবং আমাদের শব্দের আছে যে কোন কিছুর ইমেজ সৃষ্টির ক্ষমতা। এ যেন একেবারে সোনায় সোহাগা, মানিকজোড়, অমূল্য দুই রতন। অবুঝ শিশুর মতো নার্ভাস সিস্টেম আর কৌশলী পিতার মতো শব্দভান্ডার। উদাহরণ স্বরূপ তোমাদের জাওয়াদ ভাইজানের সাথে বাচ্চাদের কোন একটা কথোপকথন চিন্তা করে দেখতে পারো।
সুমাইয়া হেসে ফেললে নূহাও হাসতে হাসতে বলল, শব্দের ক্ষমতাকে ব্যক্তির মানসিক অবস্থা পরিবর্তনের জাদুর কাঠির সাথে তুলনা করা হয়। গবেষণাতেও দেখা গিয়েছে সাফল্যের অনুভূতি মানুষের সফলতার পথে চলাকে ত্বরান্বিত করে। শব্দের প্রয়োগে মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার ভেতরে প্রবাহিত আবেগের ধারাকে। নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও তৈরি করতে পারে ইতিবাচক আবহ। অনেক আশা, উচ্ছ্বাস নিয়ে জীবনকে ঘিরে নানান রঙের স্বপ্ন সাজাই আমরা। কিন্তু খুব কম সময়ই জীবন আমাদের সামনে সেভাবে হাজির হয়, যেভাবে আমরা পেতে চেয়েছিলাম, পরিকল্পনা করেছিলাম। যারফলে আশাভঙ্গ হয় আমাদের, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে আমরা হই বিপর্যস্ত, দিশেহারা, হারিয়ে ফেলি জীবনের স্বাভাবিকত্ব। জীবনের এমন হতাশা ঘেরা মুহুর্তগুলোতে নির্ভরযোগ্য একটা আশ্রয় খুঁজে ফিরি। যে কোনো একটা অবলম্বন যাকে আঁকড়ে জীবন ফিরে পাওয়া যাবে জীবনের স্বাভাবিক গতি। এমন কিছু বা এমন কেউ যার সম্মুখে খুলে দেয়া যাবে মনের বদ্ধ ঘরের দরজা, জানালা। যে শীতের সকালের সোনা রোদ হয়ে উঁকি দেবে মনের কুয়াশাচ্ছন্ন কোণে। যার হাত ধরে হাজির হবে সুবাসিত বিশুদ্ধ বাতাস। বুকের মাঝে দলা পাকানো না বলা কথাগুলো যাকে বলে নিজেকে করে নেয়া যাবে নির্ভার। যে মনে জ্বালাবে আশার নতুন দিয়া। যার প্রভাবে নিজেকে আর মনে হবে না ভীষণ অসহায়। একটা স্বস্থিকর আশ্রয় আসলে মানুষের খুব বেশি প্রয়োজন। যার ছায়ায় বসলে মন উপলব্ধি করবে, না এখনো নিঃশেষ হয়ে যাইনি আমি। এখনো বাকি আছে অনেককিছুই নতুন করে শুরু করার মতো।
সুমাইয়া হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের আপ্পার ছায়ায় আমিও এমনটাই ফিল করি।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তবে এই যে মনে নতুন করে বিশ্বাস জন্মানো মূলত এটিই হচ্ছে হিপনোটিজম। হতাশার বাদল সরিয়ে মনের আকাশে আশ্বাসের সূর্যকিরণ উঁকি দেয়াটাই হিপনোটিজম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, হিপনোসিস যে শুধুমাত্র থেরাপীস্টরাই করতে পারবে এমন কোন নিয়ম নেই। যে কেউ চাইলে নিজেই নিজেকে হিপনোটিক সাজেশন দিতে পারে। এটাকে অটো সাজেশনও বলা হয়ে থাকে। যেহেতু নিজেই এখানে নিজের থেরাপীস্ট। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, হিলিং পাওয়ার সবার ভেতরেই আছে। আমাদের কথা যদি অন্য কারো জন্য স্বস্থির উৎস হতে পারে, তাহলে নিজের জন্য কেন নয়? অন্যদেরকে যদি আমরা তাদের নেতিবাচক পরিবেশ-পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়ার জন্য উৎসাহ দিতে পারি, প্রেরণা যোগাতে পারি। তাহলে নিজেকে কেন পারবো না? চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবো ইনশাআল্লাহ। তবে এজন্য মন থেকে সমস্ত নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে বোঝাতে হবে। ঠিক যেমন করে আমরা অবুঝ কোনো শিশুকে বোঝাই ঠিক সেভাবে। এটিই হচ্ছে সেলফ হিপনোটিজম। যেমন, কোন পরিস্থিরিতে নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করাটা হয়তো খুব কঠিন আমার জন্য। আমাকে যা করতে হবে তা হচ্ছে যত্ন ও ধৈর্য্য সহকারে নিজেকে বোঝাতে হবে ব্যাপারটা মোটেই কঠিন নয় তোমার জন্য। তুমি চাইলেই পারো শান্ত ভাবে ঐ পরিস্থিতিটাকে মোকাবেলা করতে। এভাবে ক্রমাগত বলতে বলতে একটা সময় আমাদের নার্ভাস সিস্টেম এই কথাটিকেই সত্যি বলে ধরে নেবে। এবং ঐ পরিস্থিতিতে উত্তেজিত না হয়ে শান্ত থাকবে।
সুমাইয়া অবাক কন্ঠে বলল, সত্যিই কি এমনটা সম্ভব? আমি নিজেই নিজের জাদুকর হতে পারবো?
নূহা হেসে বলল, চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবে ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া হিপনোটিক সাজেশন ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই বিস্ময়কর বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং এটি আমাদের নিত্যজীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। যেমন, কোন ব্যর্থতায় হয়তো তুমি ভেঙে পেরেছো। আপনজনদের কেউ যখন পাশে বসে মাথায় বা পিঠে হাত বুলিয়ে আশা জাগানিয়া কয়েকটা শব্দ বলে, আরেকবার চেষ্টা করে দেখতে বলে, তখন হতাশার আঁধারে এক বিন্দু আলো নিয়ে হাজির হয় ছোট্ট একটা জোনাকি। আশা জেগে ওঠে আবারো। ইচ্ছে জাগে আরেকবার চেষ্টা করে দেখার। খুব প্রিয় কারো সাথে হয়তো মানসিক দ্বন্দ্বটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে সেখান থেকে শুধু সমাপ্তির দরজাটাই দেখা যাচ্ছে। তখন কাছের কেউ যখন বদ্ধ কোন একটা দরজা খানিকটা খুলে দিয়ে বলেন, সমাপ্তির আগে এই পথটা ধরে আরেকবার হেঁটে দেখো। আপনজন যখন বলছেন দেখিই না খানিকটা পথ চলে। এমনও তো হতে পারে হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এমন চিন্তা থেকে ব্যক্তি নিজেকে বোঝাতে শুরু করে এবং আরেকবার চেষ্টা করে। এই যে নিরাশার আঁধারে বিশ্বাসের দিয়া জ্বলে ওঠা, ছেড়ে দেয়া হালকে আবারো কাঁধে তুলে নেয়ার মতো মানসিক জোর ফিরে পাওয়া এসবই হিপনোটিজমের অংশ। আবার অনেক পরিবারেই দেখা যায় একজন সদস্য এমন থাকেন যাকে এক বাক্যে বলা যায়, হেড অব দ্য ফ্যামিলি। পরিবারের সর্বময় নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকে। যারকথা সবাই শোনেন, মেনে চলেন। যে কোন বিপদ-আপদ-সমস্যার সময় পরামর্শ নেবার জন্য সবাই তার কাছেই ছুটে যায়। এবং দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা থাকে তিনি যা বলবেন তা অবশ্যই কল্ল্যাণকর কিছুই হবে। এই যে নিজের কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা সবার মধ্যমণিতে পরিণত হওয়া এটা মূলত সেই ব্যক্তির হিপনোটিক পারসোনালিটির জন্যই। তাঁর বিচার-বিবেচনা, বুদ্ধি, আন্তরিকতা, অভিজ্ঞতা এবং বোঝানোর ক্ষমতাই তাকে সবার মনে বিশেষ একটা স্থানে অধিষ্ঠিত করে। ঠিক একই ভাবে পুনঃপুনঃ চেষ্টার দ্বারা অধিষ্ঠিত হওয়া যায় নিজের কাছেও। মূলত পরিবশ-পরিস্থিতি, অবস্থা ও অবস্থান অনুযায়ী নিজের পার্সোনালিটির প্যাটার্নের পরিবর্তন ঘটনোটাই সেলফ হিপনোটিজমের মূল কথা। বুঝতে পেরেছো?
সুমাইয়া হেসে বলল, জ্বি আপ্পা। তারমানে আমাকে এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে, নিজেই নিজেকে বলতে হবে আমি আমার ভুলগুলোকে মেনে নিতে পারি। নিজের ভুল মেনে নেবার মাঝে হেরে যাবার কিছু নেই। বরং নিজের ভুলকে মেনে নিলেই আত্মোন্নয়নের পথে এগিয়ে চলাটা দ্রুততর হয়।
নূহা হেসে বলল, মাশাআল্লাহ এই তো বুঝে ফেলেছো। এখন তাহলে নেক্সড লেসনে যাই চলো। চা বানানোতে।
সুমাইয়া হেসে বলল, জ্বি আপ্পা।

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...৩




আমাদের সমাজে এত অন্যায়, অবিচার, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, দানবিকতা, বিশৃংখলা ইত্যাদি কিছুই থাকতো না যদি মানুষের মধ্যে সঠিক শিক্ষা থাকতো। এমন শিক্ষা যা মনুষ্যত্ব, বিবেককে জাগ্রত করে। মানুষের সামনে করণীয় ও বর্জনীয়রও তালিকা উপস্থাপন করে। দিক নির্দেশনা দেয় আত্নসংশোধন ও আত্মপর্যালোচনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির পথে চলার। উদ্ভাসিত করে জীবনের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও গন্তব্যকে। এবং এঁকে দেয় সেই গন্তব্যে পৌঁছার নকশা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এমন শিক্ষা ব্যবস্থা কি নেই? যেখান থেকে আমরা জেনে নিতে পারি, শিখে নিতে পারি কল্যাণ ও অকল্যাণের পার্থক্য নির্ণয়? যেখানে আমাদের ভুলগুলো হতাশা চোরাবালিতে আঁটকে ফেলবে না আমাদেরকে। বরং ভুলগুলো নতুন রূপে বিকশিত হয়ে সুবাসিত করবে জীবনকে ফুলের মতো। পৃথিবীকে সুন্দর, সুশোভিত, নিরাপদ একটি সুখের আবাস হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মানবিকতা, নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ। কারন মানুষের নিজেদের মধ্যে যদি মানবিকতা, নীতিবোধ, মূল্যবোধ না থাকে তাহলে তাদের দ্বারা পৃথিবীতে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য নেমে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এমন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি নেই যেখানে হাতে কলমে আমাদেরকে শেখানো হবে, বোঝানো হবে মানবতাবোধ, মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা, আকার, প্রকার, বিভেদ? অবশ্যই আছে। এমন শিক্ষা ব্যবস্থাও আছে, এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও আছে। মূলত সকল শিক্ষার প্রাথমিক সূতিকাগার হচ্ছে পরিবার। পারিবারিক সুশৃঙ্খল, আদর্শিক, নিয়মনীতি, মূল্যবোধ, আন্তরিকতা পরিপূর্ণ পরিবেশে যখন শিশুরা বেড়ে ওঠে। তখন তাদের ব্যক্তিত্বে নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, মূল্যবোধ পরিপন্থী আচরণ ঢোকার প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। আমাদের সমাজে এতসব অশান্তির নেপথ্যে আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো বহুলাংশে দায়ী। যদি পরিবার থেকে জীবনকে বিকশিত করার যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়, যদি পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক সম্পর্কর বন্ধুত্বপূর্ণ, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা পরিপূর্ণ রাখার ব্যাপারে সদস্যদের সবাই সজাগ ও সচেতন হয়, তাহলে বাইরের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বেঁচে থাকাটা অনেক সহজ হয়ে যায়। উল্টো তাদের মধ্যের ইতিবাচকতা ও কল্ল্যাণময়তা প্রভাবে প্রভাবিত হয় মানুষ, সমাজ। কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমানে আমাদের খুব কম পরিবারের মধ্যেই সুদৃঢ় আত্মিক বন্ধন বিদ্যমান। বাইরে থেকে অনেক পরিবারকেই সুখী ও সুশৃংখল মনেহলেও ভেতরের অবস্থা একদমই তার বিপরীত। সুন্দর একটা পৃথিবী, সুন্দর একটা জীবন গড়ার স্বপ্ন যারা দেখে তাদের সেজন্য সবার আগে নিজ নিজ পরিবারকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল, আদর্শিক করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো যখন মজবুত হবে, ভালোবাসা পূর্ণ হবে তখন জগতের সমস্ত নেতিবাচক প্রভাবের মোকাবেলায় আমাদের পরিবার হবে শক্তিশালী এক দূর্গ। তাই সমাজের বিশৃঙ্খলা দেখে, পরিবারে স্বার্থের উপস্থিতি দেখে মন খারাপ করে ভেঙে পড়লে হবে না, হতাশ হলে হবে না। বরং শক্তিশালী এক দূর্গ হিসেবে নিজ নিজ পরিবারকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে হবে। এবং সেই স্বপ্নকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে অবিচল সম্মুখ পানে ধাবিত হতে হবে। যখন মনে স্বপ্ন থাকে, স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেবার স্পৃহা থাকে তখন কোন বাঁধাবিপত্তি আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারে না। তাই শুধু স্বপ্ন দেখা আর সংগোপনে লালন করার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। স্বপ্নটাকে আকাশ ছোঁয়া মনেহয়? তোমাদের উড়ায় ডানা নেই ভেবে থমকে যেও না। বরং স্বপ্নকেই ডানা বানিয়ে উড়তে শুরু করো।
এতক্ষণ একদম পিনপতন নীবরতা ছেয়ে ছিল ঘরের ভেতর। সবাই নিঃশব্দে শুনছিল আত্মজার কথাগুলো। কিন্তু শেষ বাক্যটা হাসির প্রলেপ মাখিয়ে দিয়ে গেলো সবার মুখেই। আত্মজাও মুখের হাসি একান ওকান সম্প্রসারিত করে বলল, স্বপ্নকেই ডানা বানিয়ে উড়তে শুরু করো। কথাটা কি ভীষণ রকম সুন্দর তাই না আপ্পা? অবশ্য জাওয়াদ ভাইজানের সব কথাই সুন্দর।
নূহা হাসি মুখে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। যারা সত্য ও সুন্দরের পথে চলাটাকে নিজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করে নেন। তারা অন্যদের জন্য এমন ফুল ছড়িয়েই সামনের দিকে ধাবিত হন।
জুম্মি দৃঢ় কন্ঠে বলল, ইনশাআল্লাহ আমরাও আজ থেকে এই মূহুর্ত থেকে সত্য ও সুন্দরের পথে চলাটাকে নিজেদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করে নিলাম।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ তোমাদের স্বপ্নে যে সত্যিই ইচ্ছা ও চেষ্টার ডানা লেগে গিয়েছে সেটা এসেই এমন জ্ঞানান্বেষণে বসে যাওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি। অন্যসময় ধমক দিয়ে গল্পের আসর ভেঙে সবাইকে জ্ঞানার্জনে বসাতে হয়। আর আজ তো উল্টো আমার গল্প করার ইচ্ছে উড়িয়ে দিয়ে বইখাতা খুলে বসে পড়েছো সবাই। যাইহোক, তারপর বল।
আত্মজা বলল, তারপর তো আর নেই আপ্পা। আর নোট করতে পারিনি। ভাইজান যখন কথা বলেন তখন শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। মনেহয় নোট করতে গেলেই সুন্দর কোন কথা মিস করে ফেললো। ভাইজান আরো অনেক কিছু বলেছিলেন গত প্রোগ্রামে আমাদেরকে। আমাদের সবার নোট মিলিয়ে মোটামুটি এইটুকুন ধরে রাখতে পেরেছি।
জুয়াইরিয়া বলল, সেজন্যই তোমার কাছে এসেছি আমরা। যাতে বাকি নোট আদায় করে নেবার পাশাপাশি তুমি আমাদেরকে শিখিয়ে দিতে পারো নিজেকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়। তারপর সেই ভালোবাসা কিভাবে ছড়িয়ে দিতে হয় চারপাশে।
সুমাইয়া বলল, হ্যা আপ্পা। কারণ ভাইজান আরো বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে আসলে ভালোবাসার খুব অভাব। ভালোবাসা শূন্যতায়, ভালোবাসার ঘাটতিতে অপুষ্টিতে ভুগছে আমাদের সম্পর্কের বন্ধনগুলো। ভালোবাসার অভাবে ঝরে যাচ্ছে স্বপ্নবৃক্ষের কলিগুলো প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই। আমরা কাউকে ভালোবাসার দাবী করে প্রতিনিয়ত তার সাথে ভালোবাসাহীন কথা, কাজ ও আচরণ করে চলি। কারণ আমরা আসলে জানিই না ভালোবাসার স্বরূপ। আমরা জানিই না কিভাবে ভালোবাসতে হয় মানুষকে। মানুষের কথা তো পরে আমরা নিজেকে নিজে ভালোবাসতেও জানি না। এই না জানাটাই যত সমস্যার মূলে। কেননা তখনই আমরা অন্যকে সঠিকভাবে ভালোবাসাতে পারবো যখন নিজেকে নিজে ভালোবাসবো। নিজেকে ভালোবাসার অর্থ কিন্তু আত্মপ্রেম বা স্বার্থপরতা নয় মোটেও। নিজেকে ভালোবাসার অর্থ স্বার্থের গন্ডি পেরিয়ে আত্মার বিকাশ সাধন। উদারতায় আকাশ ছুঁয়ে দেয়া, গভীরতায় সমুদ্রকে বুকের মাঝে ধারণ আর সকল নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে পাহাড়সম দৃঢ়তা, অনড়টা অর্জন। তাই সবার আগে তোমাদেরকে নিজেকে ভালোবাসতে হবে। তারপর সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হবে জগতময়। ভালোবাসার সুতোয় গাঁথতে হবে সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে। অতঃপর ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দিতে হবে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতিকে’।
নায়লা বলল, আমরা নিজেরা একটা জিনিস রিয়ালাইজড করেছি আপ্পা। আমরা অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা নেই নিজেকে গড়ার জন্য। কিন্তু কিছুদিন পরেই সবকিছু ভুলে আবার যে যেমন ছিলাম তেমনি হয়ে যাই। কোন কোন ক্ষেত্রে আগের চেয়েও খারাপ অবস্থানে অবনতি হয়। গত প্রোগ্রামে ভাইজানের আলোচনা শোনার পর আমাদের মনেহয়েছে, আমাদের মূল সমস্যা আসলে এটাই। আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রকৃত অর্থে ভালোবাসতে পারিনি এখনো। নিজেকে যথাযথ ভালোবাসতে শিখিনি বলেই আমাদের স্বপ্নগুলো বারবার ডানা ভেঙে জমিনে আছড়ে পরে। আমরা তাই সবার আগে নিজেদেরকে সঠিক ভাবে ও পরিমিত মাত্রায় ভালোবাসতে চাই। ভালোবাসার সুতোয় গাঁথতে চাই আমাদের জীবনকে ঘিরে আবর্তিত নানান সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে। এরপর সুন্দর ও পবিত্র জীবনের আহ্বান পৌঁছে দিতে চাই আলোকিত পথ থেকে অনেক দূরে অবস্থানরত মানুষদের কাছে।
আমাদেরকে শিখিয়ে দাও না আপ্পা নিজেকে ভালোবাসা এবং নিজ স্বার্থের গন্ডি ছাড়িয়ে অন্যকে ভালোবাসা। নিজের উত্তম গুনাবলীগুলোকে পরশ পাথর বানিয়ে তার ছোঁয়ায় বদলে দেয়া চারপাশের নেতিবাচক পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষকে। বেশ আবেগঘন কন্ঠে বললো জুনি।
হাদিয়া বলল, আমরা সবাই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে আলোকিত মানুষ হতে চাই। আল্লাহর সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টির পথে চলে দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে কল্ল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। ভুলের স্রোতে আর ভাসতে চাই না। আকাশের বুকে নক্ষত্র হয়েও জ্বলজ্বল করতে চাইনা। আমরা জমিনের বুকে একবিন্দু আলোকধারী জোনাকি হতে চাই।
নূহা হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ আমিও তো এমনটাই চাই। আজকে তোমাদের মধ্যেও চাওয়াটা অনেক বেশি জোড়ালো দেখতে পাচ্ছি অতীতের চেয়ে। আমরা সবাই যখন এমন সম্মিলিত ভাবে নিজেদেরকে ভালোবাসতে শিখবো এবং অন্যদেরকে ভালোবাসার বাঁধনে জড়িয়ে নিতে শিখবো। ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে আমাদের চারপাশ ভালোবাসাময় হয়ে উঠবেই। মানুষ একদিন উপলব্ধি করবেই নিজের শান্তি স্বস্থির আশায় তারা যে ঘৃণা, অরাজকতা, হানাহানির পথ বেছে নিয়েছে সেটা তাদের জন্যও ধ্বংসাত্মক। প্রশান্তি চাইলে সত্য ও সুন্দরের পথেই চলতে হবে। সুখ, সম্মান ও সমৃদ্ধি চাইলে ভালোবাসা দিয়েই সেটা আদায় করে নিতে হবে। এইকথা গুলো তোমাদেরকে এজন্যই বলছি যাতে চারপাশের নেতিবাচক, পরিবেশ-পরিবেশ ও মানুষ দেখে, তাদের কর্মকান্ড দেখে তোমরা হতাশ না হও, তোমাদের মন দুর্বল না হয়ে পরে। নিজেকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা সমূহের একটি আমাদের চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষ।
হাদিয়া বলল, একদম ঠিক বলেছো আপ্পা। আমি আমার পরিবারের কারণেই শত চেষ্টার পরেও সামনে এগুতেই পারিনা। উনাদের নেতিবাচক কথা ও কাজের প্রভাব থেকে বেশির ভাগ সময়ই দূরে থাকতে পারিনা। তাই প্রায়ই দেখা যায় পরিকল্পনা তো করি সুন্দর কিছুর কিন্তু পরিস্থিতির কারণে করে ফেলি অসুন্দর কিছুই।
নূহা বলল, আসলে যে কোন সমস্যা সমাধানের প্রথম শর্ত হচ্ছে, সমস্যাটিকে মেনে নেয়া। প্রায় সময়ই দেখা যায় আমাদের উপর আপতিত সমস্যাটিকে আমরা মেনে নিতেই প্রস্তুত থাকি না। যারফলে সমস্যাটা যতটা প্রভাব সৃষ্টিকারী থাকে, তারচেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে আমাদের জীবনে। জীবন মানেই যেহেতু সমস্যামুখরতা, তাই সমস্যাসমূহকে মেনে নেয়াতেই বুদ্ধিমত্তা। যখন আমরা কোনকিছুকে মেনে নেই তখন সেটা থেকে বেরিয়ে আসাটা সহজ হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, সমস্যাটা যদি কোন মানুষ হন। এবং জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কোন মানুষ হন সেক্ষেত্রে প্রথমেই যা করতে হবে সেটা হচ্ছে, সেই মানুষটার পজেটিভ দিক সমূহ চিন্তা করা। ব্যক্তির পজেটিভ দিক সমূহ আমাদেরকে শক্তি যোগায় তার নেগেটিভ দিক সমূহকে জয় করার ব্যাপারে। যেহেতু আমাকে সেই মানুষটির সাথেই থাকতে হবে তাই নিজের কল্ল্যাণের লক্ষ্যেই তার দিকে ক্ষমার হাত প্রসারিত করতে হবে। আসলে জীবন সফরে যাদেরকে সাথে নিয়েই চলতে হবে তাদের সাথে সম্পর্কটা সুন্দর করে তোলার ইচ্ছে, চেষ্টা, অধ্যবসায় ও সাধনা থাকা উচিত আমাদের। তাই সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধিত কারো সাথে অতীতে যা হয়েছে সেসব ভুলে তার সাথে মানসিক দুরুত্ব কমিয়ে সম্পর্ক সুন্দর করার চেষ্টা করতে হবে। কাজটা যদি সহজ কিছু নয় মোটেও। কেননা সম্পর্ক সুন্দর করার উদ্যোগ যারা নেন তাদেরকেই কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করতে হয় বেশি। কারণ কাউকে ভালোবাসা অনেক সহজ কিন্তু কারো ভালোবাসার পাত্র হওয়া যথেষ্ট কঠিন। তারচেয়েও বেশি কঠিন সম্পর্কের বন্ধনে ভালোবাসাকে সজীব ও সুবাসিত রাখতে পারাটা। তাই তোমাদেরকে সর্বাগ্রে যা করতে হবে তা হচ্ছে, নিজ নিজ চলার পথের প্রতিবন্ধকতা সমূহকে খুঁজে বের করতে হবে এবং মেনে নিতে হবে সেটিকে। অতঃপর সেটাকে কিভাবে সুন্দর থেকে সুন্দর পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সংশোধন করা যায় তা খুঁজে বের করতে হবে।
সুমাইয়া বলল, হ্যা আপ্পা। কিন্তু আমাদের পারিবারিক বন্ধনগুলো মোটেই তোমাদের আনন্দবাড়ির মতো নয়। তাই বড় বেশি ছড়ানো ছিটানো সম্পর্কের মোতিগুলো।
নূহা হেসে বলল, আমাদের আনন্দবাড়িও কিন্তু সবসময় এমন ছিল না। আমাদের সম্পর্কের বন্ধনগুলোও অনেক ছড়ানো ছিটানো ছিল। সম্পর্কগুলোকে একসাথে গাঁথার জন্য ভালোবাসার সুতোও ছিল না প্রতিটি মনে। কিন্তু ইচ্ছে, চেষ্টা, সাধনা, অধ্যবসায়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল আমাদের আনন্দবাড়ি।
আমাদেরকে তাহলে আনন্দবাড়ি গড়ে তোলার গল্পও শোনাতে হবে আপ্পা। অনেক সময়ই ক্লাসের কাউকে যখন ভালো কিছু বলতে যাই ওরা উল্টো বলে, তোমাদের জন্য এমনটা বলা অনেক সহজ কারণ তোমাদের পারিবারিক বন্ধন অনেক সুন্দর। কিন্তু আমাদের জন্য এতটা সহজ না। তখন চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমরা জন্মের পর থেকেই আমাদের পরিবারের সবাইকে এমন দেখে আসছি। চারিদিকে ভালোবাসার ছড়াছড়ি দেখে আসছি। আমরা জানিই না আমাদের আনন্দবাড়ি গড়ে তোলার জন্য আমাদের বাবা-মায়েরা, ভাইয়ারা কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কি কি বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু এসব জানাটাও তো জরুরী তাই না আপ্পা?
জুম্মির প্রশ্নের জবাবে নূহা হেসে বলল, অবশ্যই তাই। তবে তোমাদের মতো আমিও বুঝতে শেখার পর থেকেই খুব সুন্দর ও ইতিবাচক পরিবেশেই নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। তবে বিভিন্ন সময় বাবা, পাপা, বাপী, ভাইয়াদের মুখে শুনেছি উনাদের নিজেদেরকে গড়ে তোলার গল্প। তারপর ধীরে ধীরে আনন্দবাড়ি গড়ে তোলার গল্প। ইনশাআল্লাহ আমি যতটুকু জানি অবশ্যই শেয়ার করবো তোমাদের সবার সাথে। কিন্তু এখন যোহরের ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে। সবাই যাও নামাজের জন্য প্রস্তুতি নাও।
বোনেরা সবাই নামাজের প্রস্তুতি নেবার উদ্দেশ্য উঠে যাবার পর নূহা আবারো বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ছোট বোনদের সবার ভেতর নিজেকে ভালোবাসা এবং সেই ভালোবাসার বাঁধনে চারপাশের সবাইকে বেঁধে নেয়ার আগ্রহ সবসময়ই খুঁজে পায় নূহা। কিন্তু আজ ওদের সবার চোখে অদ্ভুত রকম আকুলতা দেখতে পেয়েছে। অনেক বেশি দৃঢ়তা ছিল ওদের প্রতিটি শব্দে। ওদের মনের এই আগ্রহ, এই দৃঢ়তা সর্বদা অটুট এবং দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করে দিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এটাই প্রার্থনা।

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...২






ছুটতে ছুটতে রান্নাঘরে ঢুকে স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো নূহা রাহাতকে ফিরনী নাড়তে দেখে। রাহাতের পাশে জারিফ দাঁড়িয়ে ছিল। নূহা ঢুকতেই পিতা-পুত্র দুজনই একসাথে নূহার দিকে তাকিয়ে, 'এ আর নতুন কি' স্টাইলের একটা হাসি দিলো। তবে জারিফ বাবার চেয়ে দু'কদম এগিয়ে সবসময়ই। সে বুড়া দাদার স্টাইলে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ওহো মা তোমার যে কি হবে সবকিছু শুধু ভুলে যাও। অন্তত আমাকে বা বাবাকে বলেও তো দিতে পারো খেয়াল রাখার কথা। যদি আমার রুমের পানি শেষ হয়ে না যেত, যদি আমি পানি নিতে কিচেনে না আসতাম তাহলে তো বাবাকে ডেকে আনতে পারতাম না। এবং সব ফিরনী পুড়ে যেতো। তখন কি হতো?
নূহার ইচ্ছে করছিল বলে, তখন পুড়ে যাওয়া ফিরনী তোকে আর তোর বাবাকে চেপে ধরে খাওয়াতাম দুষ্টু ছেলে। কিন্তু লিখিত সব চিঠি যেমন পোষ্ট করা হয় না, লেখার পরেও কিছু টেক্সট সেন্ড করা হয় না। তেমনি মুখে চলে আসা সব কথাও বলতে হয়না। সেগুলোকে ভেতরের দিকে ঠেলে দিয়ে ভিন্ন কিছু বলতে হয়। নূহাও তাই বলতে ইচ্ছে করা কথাগুলো সজোরে ভেতরে ঠেলে দিয়ে হাসি মুখে বলল, জাযাকাল্লাহ বাব্বু সোনা। তুমি আর তোমার বাবা না থাকলে আমার যে কি হতো ভেবে পাইনা।
রাহাত হেসে বলল, জারিফ মাকে বলো কিছুই হতো না, শুধু আজ ফিরনীটা পুড়ে যেতো।
রাহাত আর জারিফের সাথে হাসিতে নূহাও যোগ দিলো। হাসতে হাসতেই পানির বটল হাতে নিয়ে বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো জারিফ। জারিফ চলে যাওয়া মাত্রই নূহার চেহারা চেঞ্জ হয়ে গেলো। চোখ নাক মুখ কুঁচকে বলল, সুযোগ পেলেই যে আপনারা পিতা-পুত্র মিলে আমাকে যন্ত্রণা করেন। এইসব কিন্তু সহ্য করা হবে না বলে দিচ্ছি। কঠিন শিক্ষা দেয়া হবে দুজনকেই। বিশেষ করে পুত্রকে। সে অতিমাত্রায় পন্ডিত হয়েছে।
রাহাত হাসতে হাসতে বলল, তোমার যত শিক্ষা দেবার আমাকে দাও। কিন্তু আমার পুত্রকে কিছু বলো না। পুত্রটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিশেষ রহমত হয়ে এসেছে আমার জন্য। তুমিই চিন্তা করে দেখো পুত্র না থাকলে কি আমি সকাল বিকাল বৌয়ের মুখে লাভ ইউ শুনতে পেতাম?
লাজুকতা মেশানো হাসি ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। মনে পরে গেলো বেশ কয়েক মাস আগে জারিফের ছুটির এক সকালে রাহাত নাস্তা করে যখন ডিউটিতে যাচ্ছিলো সবসময়ের মতো নূহা সালাম এবং ফী আমানিল্লাহ বলে বিদায় জানিয়েছিল রাহাতকে। জারিফ পাশেই বসে খেলছিল। হঠাৎ বলে উঠেছিল, মা তুমি শুধু সালাম আর ফী আমানিল্লাহ বলছো কেন? আর কিছু বলবে না বাবাকে? নূহা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল, আর কি বলবো? জারিফ জবাবে বলেছিল, তুমি চিন্তা করে দেখো আর কি বলতে হয় বিদায়ের সময়। নূহা তখন বুঝে নিয়েছিল জারিফ কি বলতে চাইছে। কারণ জারিফ স্কুলে বা বাইরে কোথাও যাবার সময় বিদায় দেবার সময় নূহা সালাম ছাড়াও সবসময়ই লাভ ইউ এন্ড মিস ইউ বাক্য দুটোও বলে। তার বাবাকেও কেন বাক্য দুটা বলা হচ্ছে না সেটাই জারিফের প্রশ্ন ছিল।) পুত্র কি মিন করছে সেটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলেছিল নূহা। কিন্তু সেই হাসিতে দমে যাবার ছেলে জারিফ না। সে ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করে দিয়েছিল, মা বাবাকে বলো। মা বাবাকে বলছো না কেন? তাড়াতাড়ি বলো বাবার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! পুত্রের অস্থিরতা দেখে নূহা লজ্জা মেশানো স্বরে লাভ ইউ এন্ড মিস ইউ বলেছিল রাহাতকে। জারিফ তখন উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলেছিল, এই তো এবার হয়েছে। এখন থেকে সবসময় এভাবে বিদায় দেবে বাবাকে। জারিফের খুশির জন্য বলতে বলতে এখন যদিও অভ্যাস হয়ে গিয়েছে কিন্তু সেদিনের কথা মনে পড়লো এখনো লাজুকতার আবেশ ছড়িয়ে যায় মনে। রাহাতকে কৌতুক ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাত বাড়িয়ে রাহাতের চেহারা আরেকদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে নূহা বলল, আপনার পন্ডিত পুত্রকে তো শাস্তি দিতেই হবে। বলাই তো হয়নি কয়েকদিন আগে সে কি কান্ড করেছে।
রাহাত হেসে বলল, কি কান্ড করেছে?
নূহা হেসে বলল, তুমি তো জানোই আমার সবচেয়ে অপছন্দের কাজগুলোর একটা হচ্ছে গাছের ফুল-পাতা ইত্যাদি ছেঁড়া। জারিফকেও আমি বুঝিয়েছি এমন কখনোই করা উচিত নয়। আর ওদের পাপার কাছ থেকে তো বৃক্ষ প্রেমের তালিম নিয়মিতই নেয় বাচ্চারা সবাই। সব মিলিয়ে গাছপালার প্রতি জারিফেরও অনেক মায়া। এখন ঘাসফুলের সময়। আমাদের বাসার পাশের পার্কটাকে মনেহয় যেন নানান ধরণের ঘাসফুলের রাজ্যে। আমার মতো আমার এক স্টুডেন্টও ঘাসফুল খুব পছন্দ করে। খুব ভালো একটা কাজ করেছিল সেই স্টুডেন্টটি। জারিফকে নিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে পার্কের সামনে আসতেই ঘাসফুল দেখে সেই স্টুডেন্ট ও তার ভালো কাজের কথা মনে পড়লো। অনেকটা অজান্তেই একটা ঘাসফুল ছিঁড়ে ফেলেছিলাম ওর জন্য। আরেকটার দিকে হাত বাড়াতে যাচ্ছিলাম এই সময় জারিফ চিৎকার শুনতে পেলাম, মা তুমি এটা কি করলে? তুমি একটা ফুলকে হত্যা করলে? তুমি হত্যাকারী হয়ে গেলে।
হেসে ফেললো রাহাত স্বশব্দে। নূহাও হাসি মুখে বলল, এখন হাসি পেলেও ঐসময় জারিফের কথা শুনে আমারো ভীষণ মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল। নিজেই অবাক হয়ে ভাবছিলাম এমন একটা কাজ কেন করলাম? কিন্তু জারিফের অস্থিরতার কারণে নিজের ভাবনাতে ফোকাস করা সম্ভব হচ্ছিলো না। ও হেলেদুলে থপথপ করে হাঁটছিল আর বলছিল, তুমি কি জানো না গাছের প্রাণ আছে? তাহলে কেন ছিঁড়লে ফুলটা? আহারে কিছুক্ষণ আগেও ফুলটা বেঁচে ছিল। কিন্তু এখন তোমার কারণে মারা গিয়েছে। মা তুমি কেমন করে পারলে ফুলটাকে মেরে ফেলতে? তুমি জানো ফুল হচ্ছে গাছের সন্তানের মতো। ঠিক আমি যেমন তোমার সন্তান। এরমধ্যে আবার দেখা হলো জারিফের এক ক্লাসমেটের সাথে। জারিফ ওর বন্ধুকে আমার হাতে ধরে থাকা ফুলটা দেখিয়ে বলল, দেখো আমার মা না এই ফুলটাকে মেরে ফেলেছে। সেই বাচ্চাটির অবাক দৃষ্টির সামনে আমার অপরাধবোধ আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু নিজের সাপোর্টে বলার মতো কিছুই ছিল না তাই চুপ করে রইলাম। এরপর ঢুকলাম সুপার মার্কেটে। সেখানে ঢুকেও এক সেলসম্যানকে আমার হাতের ফুলটা দেখিয়ে বল, জানো আমার মা এই ফুলটাকে হত্যা করেছে। সেলসম্যান দিলো হাসি।
রাহাত হাসতে হাসতে বলল, তারপর?
নূহা হেসে বলল, তারপর আমি ওকে টেনে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, কেন তুমি এমন করছো? ঠিকআছে মা নাহয় একটা ভুল করে ফেলেছি। তাই বলে কি তুমি সবাইকে ডেকে ডেকে বলবে? জারিফ জবাব দিলো, তুমিই তো বলেছো কেউ অন্যায় বা ভুল করলে তাকে শুধরে দিতে। তা না হলে একই ভুল বার বার করবে। তাই আমি তোমাকে শুধরে দিচ্ছি। তখন মনে পড়ল কারো ভুল এমন ঢাক পিটিয়ে শুধরে দিতে নেই একথাটা এখনো শেখানো হয়নি জারিফকে। তাই আর কিছু না বলে ঐসময় চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভাবনারা মোটেই চুপ করে বসে রইলো না। তবে অনেক আত্নদহনের মাঝেও প্রাপ্তি খুঁজে পেয়েছিলাম একটা। ভুল করার সাথে সাথে ভুলের উপলব্ধি জাগিয়ে যাবার মতো আশেপাশে কেউ থাকাটা খুবই সৌভাগ্যের। বাবা-মামণি ও ভাইয়াদের গন্ডির অনেক বাইরে থাকি বলেই আমার ছোট ছোট ভুলগুলো অসংশোধিতই থেকে যাচ্ছিলো অনেক বছর ধরে। আলহামদুলিল্লাহ এখন একজন গুরু আছে আমার। যে সারাক্ষণই তৈরি থাকে আমার ভুল ধরা, শুধরে দেয়া ও শাসন করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ।
রাহাত হেসে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। পুত্রকে যেহেতু গুরু মেনেই ফেলেছো তাহলে তো তার এই সমস্ত পান্ডিত্য সহ্য করতেই হবে এখন।
নূহা হেসে বলল, হুম, নো অপশন।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাহাত বলল, তোমার মেহমানদের মনেহয় আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আমরা পিতা-পুত্র তাহলে ব্যাগ গুছিয়ে বিদায় নেই এখন।
রাহাত আর জারিফ চলে যাবার পর রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে রুমে এসে বসতে বসতে না বসতেই ক্রমাগত ডোরবেল বেজেই চলছে শুনতে পেয়ে বুঝতে মোটেই কষ্ট হলো না দল বেঁধে তার এলোমেলো পাগলা স্বভাবের জুনিয়র ভগ্নী বাহিনী হাজির হয়েছে। হাসি মুখে দরজা খোলার জন্য রওনা হলো নূহা। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো আত্মজা, জুয়াইরিয়া, নায়লা, জুম্মি, জুনি, হাদিয়া আর সুমাইয়া। সম্মিলিত সালাম দিয়ে নূহার জবাবের অপেক্ষা না করেই দল বেঁধে সব রান্নাঘরের দিকে ছুট লাগালো। ঘটনা কি বোঝার জন্য নূহাও বোনদের পেছন পেছন রান্নাঘরের দরজায় পৌঁছে আত্মজা, নায়লা আর সুমাইয়ার বিজয় ধ্বনি শুনতে পেয়ে বুঝতে আর বাকি রইলো না তাদের জন্য খাবারের কি আয়োজন করেছে সেটা নিয়ে দুই গ্রুপ হয়ে গেস করার চেষ্টা করেছে। এবং আত্মজার দলের আন্দাজ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। নূহাকে দরজায় দেখে উল্লাসিত কন্ঠে নায়লা বলল, আপ্পা তুমি এত কিছু রান্না করেছো আমাদের জন্য? একা একা অনেক কষ্ট হয়েছে তোমার তাই না?
নূহা হেসে বলল, একা একা রান্না করেছি কে বললো তোদের? আমার হেল্পার সর্বক্ষণ সাথে সাথে ছিল আলহামদুলিল্লাহ।
হেসে ফেললো মেয়েরা সবাই। সুমাইয়া হাসতে হাসতে বলল, তোমার হেল্পারকে বলেছো তো তুমি যে দুদিনের জন্য আমাদের দ্বারা বুকড?
নূহা হেসে বলল, বলেছি বলেই তো হেল্পার সাহেব উনার পুত্রকে নিয়ে দুদিনের জন্য শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হতে গিয়েছেন। এখন তোরা সবাই যেয়ে ড্রইংরুমে বোস আমি সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।
না আপ্পা তুমি এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছো আমাদের জন্য। তুমি গিয়ে আরাম করে বোস আমরা নাস্তা রেডি করে নিয়ে আসছি।
জুয়াইরিয়ার কন্ঠে কন্ঠ মিলালো বাকি সবাইও। বোনদের কথা হাসি মুখে বিনা বাক্যে ব্যয়ে মেনে নিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ালো নূহা। সাফিনকে এখনো বাগানে দাঁড়িয়ে থাকতে থেকে বলল, তুই এখনো এখানেই দাঁড়িয়ে আছিস?
সাফিন হেসে বলল, তোর ফিরনীর অপেক্ষা করছি। রাহাত ভাইয়া বাসায় আছেন দেখেই বুঝে নিয়েছিলাম ফিরনী অক্ষত আছে। বৌয়ের যে কোন অপকর্মের উপর পর্দা টেনে দেয়াতে রাহাত ভাইয়ার বিশ্ব রেকর্ড আছে।
নূহা হেসে ফেলে বলল, হাজবেন্ড ওয়াইফদের এমনই হতে হয়। পোশাক তো এজন্যই বলা হয়েছে একে অন্যের। যাতে সর্বদা সর্বাবস্থাতেই পরস্পরকে ঢেকে রাখতে পারে।
হুম, কিন্তু বাস্তবতা কেন জানি ভিন্ন কিছুরই প্রদর্শন করে। সেই তুলনায় প্রেমিক প্রেমিকাদের পরস্পরকে আড়াল করে রাখার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। বিয়ে হওয়া মাত্রই কেন জানি ছেলেমেয়ে গুলো চিৎকার করে করে সবাইকে নিজ নিজ পার্টনারের দোষের চর্চা শুরু করে দেয়। দু’তিন জন ফ্রেন্ডকে এই দুরাবস্থায় ভুগতে দেখছি বর্তমানে। মজার ব্যাপার কি জানিস? বিয়ের আগে ওদের কাছে একে অন্যের দোষগুলোকেও সুইট আর কিউট লাগতো। আর এখন বিষের মতো লাগে পরস্পরের গুণগুলোকেও। এই ব্যাপারটা নিয়ে তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম। এমন হয় কেন বলতো?
নূহা বলল, আমি প্রায়ই ভাবি কেন এমন হয়? কেন সুন্দর সম্পর্কগুলোর পরিণতি এতটা অসুন্দর হয়। আসলে যুদ্ধ জয়ের চেয়েও সেই অর্জিত বিজয়কে অক্ষুণ্ণ রাখাটা কঠিন। কোন সম্পর্ক কতটা ঝড়-ঝাপটা, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধতা পেরিয়ে গন্তব্যের দেখা পেয়েছে তারচেয়েও কঠিন সেই গন্তব্যে স্থির থাকাটা। অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিলো। রিল লাইফের এমন হ্যাপি এন্ডিংটা মূলত রিয়েল লাইফের মোড়ক উন্মোচন। তাই হয়তো সমস্ত পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে যে ছেলেটা মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল। চার বছর যেতে না যেতে সমস্ত ভালোবাসা ভুলে দুই সন্তান মেয়েটির কোলে তুলে দিয়ে অন্য আরেকটি মেয়ের হাত ধরে তার জীবন থেকে বিদায় নিতে পারে। মনে প্রশ্ন জেগেই ওঠে এ কেমন ভালোবাসা? যারজন্য সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল একদিন! সেই তাকেই আবার কিভাবে ছেড়ে যেতে পারলো অন্য কারো জন্য? মুগ্ধকর ভালোবাসাময় সম্পর্কগুলো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তিক্ততায় কেন ভরে ওঠে?! প্রশ্নটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে বুকের গহীন থেকে। কেন যেই মানুষ দুজন সমস্ত দুনিয়া থেকে একে অন্যেকে আগলে রাখার অসাধারণ সুন্দর উদাহরণ উপস্থাপন করে, নিজেরাই আবার তা গুঁড়িয়ে দেয়? একদা যার জন্য শত আঘাত হাসি মুখে সইতে প্রস্তুত ছিল। তাকে কিভাবে আঘাত করে নিজেই?! কিভাবে কাঁদায় সেই মানুষটাকে যার কান্নার চেয়ে অসহনীয় কিছুই ছিল না তার কাছে? যার দিকে ছুটে আসা কারো নেতিবাচক কোন সম্বোধনে ফুসে উঠতে দ্বিধা করতো না, তাকেই কিভাবে হেয় করে প্রকাশ্যে অন্যের সম্মুখে?!
সেটাই তো প্রশ্ন, কিভাবে করে?
আসলে যে কোন সম্পর্ক ই গড়ে তোলার চেয়ে টিকিয়ে রাখাটা কঠিন। যতটা সাধনা, অধ্যবসায় সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়, তারচেয়ে বেশি সাধনার প্রয়োজন সেই সম্পর্কে বিদ্যমান হক সমূহ আদায় করাটা। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই একটা সম্পর্ক তৈরি হলে যাবার পর মানুষ সেটাকে ফর গ্রান্টেড ধরে নেয়। যারফলে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে আদর, কদর। সম্পর্কটি কখনো বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে ছটফট করে, কখনো বা পানির অভাবে তৃষ্ণার্ত প্রহর কাটায়। এরপর একটা সময় এখানেও কার্যকর হয়ে ওঠে মানুষের স্বভাবজাত অভ্যস্ততা। অক্সিজেন ছাড়াও বেঁচে থাকে প্রাণহীন সম্পর্ক। ভুলে যায় পানির স্বাদ, ধীরে ধীরে হয়তো প্রয়োজনীয়তা! সম্পর্কের বদলে যাওয়া এই রুপ বড়ই ভয়ংকর মনেহয়! তবুও কেন জানি না ক্ষুদ্র জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতাতে বার বার দেখতে হয় অমৃতের এমন বিষে রুপান্তর। মূলত, যত্নের অভাবেই বদলে যায় সুন্দর সম্পর্কগুলো। আমরা কাছের মানুষদের ব্যাপারে, আপনজনদের ব্যাপারে মোটেই যত্নশীল নই। বাইরের কারো কাছে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার ব্যাপারে আমাদের কত সাধনা থাকে, পরিশ্রম থাকে কিন্তু পরিবারের কারো কাছে নিজেকে আরো উত্তম রূপে উপস্থাপনের জন্য আমরা খুব কমই হোমওয়ার্ক করি। উল্টো আরো বলি, বাইরে কত শ্রদ্ধা, সম্মান করে মানুষ আমাকে। ঘরের মানুষের কাছেই কোন মর্যাদা পেলাম না। আমার কোন মূল্যই নেই কারো কাছে। কিন্তু একবারও নিজেকে প্রশ্ন করে দেখে না, নিজেকে প্রিয় কারো অমূল্য সম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য সে কি আসলেই কি করেছে?
সাফিন বলল, আসলেই তাই। আচ্ছা প্রিয় মানুষগুলোর কাছে স্পেশ্যাল হবার জন্য কি কি করা উচিত আমাদের?
নূহা হেসে বলল, কারো মনের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করার জন্য তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখাটা অবশ্যই জরুরি। তবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান যে শুধু বিশাল কিছু করার মাধ্যমেই রাখতে হয় এমনটা কিন্তু নয়। এমনটাও নয় যে সাংঘাতিক কোন ত্যাগের বিনিময়েই মেলে কারো হৃদয়ে স্পেশাল মর্যাদা। মানুষ মূলত অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ছোট্ট ছোট্ট কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা। যেমন, “কখনো মেনে নিয়ে, কখনো বা মানিয়ে চলে, কখনো নিঃশব্দ সহচর, কখনো অভিনব কৌশলে! কখনো হয়ে প্রেরণা, কখনো করে সমালোচনা, কখনো শুধরে দিয়ে ভুল উন্মুক্ত করা সম্ভাবনা! হয়ে বিশ্বাস মনেতে জাগিয়ে যাওয়া আশ্বাস, উদারতা আকাশ ছোঁয়া, সজীবতার আবাস! প্রকাশ করতে নিজের মতামত, না দিয়ে অন্যকে ক্ষত, বুঝে নিয়ে অবগুণ্ঠিত চাওয়া, জানিয়ে দেয়া নিজ ভিন্ন মত!” তবে কারো কাছে স্পেশাল হবার জন্য ভালোবাসার চেয়ে স্পেশাল আর কিই বা হতে পারে? আবেগের প্রকাশ দ্বারে শুধু একটা ভালোবাসার ফিল্টার লাগিয়ে নিতে হয়। তাহলে কারো শাসন, অভিযোগ, রাগ, বকে দেয়া, সমালোচনা সবকিছুর মাঝেই দেখা মেলে ভালোবাসার। আর যার প্রতিটা আবেগ ভিন্ন ভিন্ন রুপে শুনিয়ে যায় ভালোবাসার কাব্য, সে স্পেশাল কেউ হয়ে যায় নিজেরও অজান্তেই।
সাফিন হেসে বলল, নোট করে রাখলাম সব কথা। ইনশাআল্লাহ ফ্রেন্ডদেরকে বুঝিয়ে বলবো।
এখন তাহলে উপরে আয় ফিরনী নিয়ে যা।
সাফিন চলতে শুরু করে বলল, তুই যেয়ে দরজা খোল। দেখবি আমি হাত বাড়িয়ে তোর সম্মুখে দন্ডায়মান। মিষ্টান্নের নাম শুনলেই সুপারম্যান পাওয়ার চলে আসে আমার মধ্যে।
হেসে ফেললো নূহা। এরপর দরজা খোলার জন্য ছুট লাগালো। সুপারম্যান ভাইকে দেখিয়ে দিতে হবে সেও যে সুপারওম্যান।

ভালোবাসার সুতোয় গাঁথি সম্পর্কের মোতি...১




হাইওয়ে রোডের পাশে বাসা হবার একটা অন্যরকম মজা আছে। ছুটন্ত গাড়ি, চলন্ত মানুষ, খোলা আকাশ, খন্ড খন্ড মেঘের উড়াউড়ি সবকিছু মিলিয়ে জীবনের জীবন্ত উপস্থিতি সর্বত্র, সর্বদা। গত কয়েকদিন আগে নিজের পড়ার টেবিলটা বারান্দার এক কোণে বসিয়ে দিয়েছে নূহা। যাতে দৃষ্টি সীমায় ধরা দেয় ভোরের আধো আলো, দুপুরের কড়া রোদ, বিকেলের নম্র উষ্ণতা, সন্ধ্যার আলো-আঁধারি, রাতের তারা ভরা আকাশ, জোছনার জোয়ার। প্রকৃতির সংস্পর্শে সারাক্ষনই যেন জীবনের সরব আনাগোনা টের পায় চারিপাশে। তাকিয়ে থাকে কখনো আনমনে মানুষের দিকে। হেঁটে চলছে সবাই নিজ নিজ জীবিকা, গন্তব্যের সন্ধানে! কত বৈচিত্র্যতা এই হেঁটে চলার মাঝেও। সূর্যকিরণ সকালের মিষ্টতার রেশ কাটিয়ে দুপুরের কড়া রৌদ্দুদের যাত্রা পথে ধীর পায়ে এগিয়ে চলছে। মিষ্টি রোদ আর মৃদুমন্দ বাতাসের দোলায় প্রকৃতির সাথে সাথে নূহার মনেও ভালো লাগার পরশ বুলিয়ে গেলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলো বড় এক খন্ড মেঘ ভাসতে ভাসতে প্রতি মূহুর্তে বদলে ফেলছে নিজের আকার। ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে বহু খন্ডে চারিপাশে। আজকাল নূহার মনের ভাবনারাও এমন ছড়িয়ে পরে ক্ষণে ক্ষণেই। ভাবনাদের বাঁধার চেষ্টা না করে ইচ্ছে মত বয়ে যেতে দেবার মজাও কিন্তু বেশ। ভাবনার স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দেয়া একটি শুকনো পাতার রূপে। তারপর স্রোতের প্রবাহে নিশ্চিন্তে ভেসে চলা। এই মূহুর্তেও নূহার ইচ্ছে করছিল নিজেকে ভাবনার স্রোতে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু এখন আপন মনে ভেসে যাবার কোন অবকাশ তার নেই। জীবনের অনেক লম্বা একটা সময় নিজ ইচ্ছের স্রোতে ভেসে পাড় করে দিয়েছে। বুকের ভেতরটা আবারো ভার হয়ে এলো নূহার। পরক্ষণেই আবার মনেহলো, ব্যর্থতার স্মরণ জীবন পথকে করে দুর্গম, যা চলে গিয়েছে তা ভুলে যাওয়াটাই উত্তম। ফিরে পেতে হারানো মনের পরিতুষ্টি, যা কিছু আছে তাতেই খুঁজে নিয়ে সন্তুষ্টি। আগত নব নব সম্ভাবনার পথ করতে হবে সুগম।
নিজ করণীয়র কথা ভাবতে ভাবতে বাগানের দিকে দৃষ্টি যেতেই দেখতে পেলো সাফিন হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে তুলে জানতে চাইলো নূহা, কি রে তুই এমন দাঁত বের করে তাকিয়ে আছিস কেন? নতুন লাগিয়েছিস?
স্বশব্দে হেসে ফেললো সাফিন। হাসতে হাসতে বলল, তুই একা একা নিজের সাথে বিড়বিড় করছিলি সেটা দেখে দাঁত বের করেছি। নতুন লাগাইনি তবে কিছুক্ষণ আগে ঘষে ঘষে মেসওয়াক করে এসেছি। একটা ক্লোজআপ দান্তিক হাসি তাই বোনের দিকে তাকিয়ে দিতেই পারি এই মূহুর্তে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তুমি একা একা কি কথা বলছিলি?
কি কথা বলছিলাম সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের সাথে একান্ত কথোপকথন বেশ জরুরি। স্বামী বিবেকানন্দ কি বলেছেন জানিস? বলেছেন, "দিনে একবার হলেও নিজের সাথে কথা বলুন। অন্যথায় এ পৃথিবীর একজন চমৎকার মানুষের সাথে সাক্ষাত লাভের সুযোগ থেকে আপনি বঞ্চিত হবেন"।
সাফিন হেসে বলল, বাহ উক্তিটা তো ভীষণ সুন্দর। তোর ভেতরের চমৎকার মানুষটার সাথে কথোপকথন কি শোনা যাবে? আজকাল প্রায়ই তোকে বিড়বিড় করতে দেখি একা একা। জানতে ইচ্ছে করে কি এত কথা বলিশ নিজের সাথে।
নূহা হেসে বলল, আচ্ছা শোনাবো কখনো তোকে আমার সাথে আমার কথোপকথন। তারআগে জানতে চাই ইফতি ভাইয়ার সাথে দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে? চুপ করে আছিস কেন? আমি ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছি ‘ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্ব, চলো করি বন্ধ’ শ্লোগান বেমালুম ভুলে গিয়ে কিভাবে তুই আর ইফতি ভাইয়া দেড় মাস ধরে নিজেদের মধ্যে সমস্যা বয়ে বেড়াচ্ছিস। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে, ভাইবোনদের সাথে মনোমালিন্য, মতপার্থক্য হতেই পারে। কিন্তু সেটা কখনোই এমন দীর্ঘ সময় বয়ে বেড়ানো উচিত না। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি কি বলেছেন জানিস? আপনজনদের প্রতি রাগ হওয়া উচিত দুধের বলকে ওঠার মতো। যাতে হালকা ফু’ই যথেষ্ট হয় গড়িয়ে পড়াকে ব্যহত করার জন্য।
সাফিন হেসে বলল, ভাইজান নিউজিল্যান্ড থেকে কবে ফিরবেন সেটা কি তুই জানিস? ভাইজানের শূন্যতা খুব ফিল করছি। ভাইজান এখানে থাকলে নিশ্চিত ইফতি ভাইয়া আর আমার সমস্যাটাকে এতটা দীর্ঘ হতে দিতেন না। আর তোর তো সময়ই নেই পরিবারের সদস্যদের জন্য। জনকল্যাণে নূহা হয়েছিস।
হেসে ফেললো নূহা। বলল, আমার তো মনেই ছিল না তোদের ঝগড়ার কথা। গতরাতে বড়মামার সাথে গল্প করার সময় কথা প্রসঙ্গে মামা যখন বললেন তখন জানতে পারলাম তোরা শান্তির শ্বেত কবুতরের পায়ে বেঁধে রাগকে উড়িয়ে না দিয়ে, মনের খাঁচায় যতনে পুষে বেড়াচ্ছিস। কবি কি বলেছেন জানিস? অভিমান অভিযোগ সমস্যার সমাধান নয়, সম্পর্কের মিষ্টতা এতে ধীরে ধীরে হয় ক্ষয়। দ্বন্দ্ব মিটায় ত্যাগ ও সমঝোতা, দূর করে অকারণ যত তিক্ততা। ভালোবাসায় সাজে ভুবন, ঘৃণাতে কভুও নয়।
বুঝতে পারছি ভুল হয়ে গিয়েছে অনেক। সত্যি বলতে আমি বেশ কয়েকবার ইফতি ভাইয়ার সাথে কথা বলার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন ভাইয়ার বলা কথাগুলো আমাকে খুব বেশি কষ্ট দিয়েছিল। যখনই ভাইয়াকে দেখি কথাগুলো মনে পড়ে বুকের মধ্যে খচখচ করতে শুরু হয়।
নূহা হেসে বলল, এজন্যই তো কবি বলেছেন, ‘সুখের পিহু গুঞ্জরনে সময়টা যখন অনন্য, হঠাৎ স্মৃতির তিক্ততা মনকে করে দেয় বিষণ্ণ। হাত নেড়ে বিদায় জানায় খুশি, বেদনার ঢেউ উঠে রাশি রাশি। প্রাপ্তির বাগিচায় চোখে ভাসে শুধুই অসংখ্য শূন্য’। আসলে এমনটা মনেহয় আমাদের সবারই হয় মাঝে মাঝে। খুব আনন্দময় ক্ষণ বিষণ্ণতায় চাদর মুড়িয়ে বসে পড়ে অতীতের তিক্ত কোন স্মৃতির স্মরণে। অতীতকে বদলানোর কোন সুযোগ নেই জানা স্বর্ত্বেও অতীত দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমরা বর্তমানকে বদলে যেতে দেই খুব সহজেই। বেশ কয়েকমাস আগে এক বোন এমন সমস্যা নিয়েই হাজির হয়েছিল আমার কাছে। স্বামীর সাথে খুবই সুখী সুন্দর সংসার বোনটির। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের শুরুর দিককার অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর ছিল না দুজনের। এখন প্রায় সময়ই অতীতে একে অন্যেকে দেয়া আঘাতের স্মরণ তাদের বর্তমান খুব সুন্দর মূহুর্তগুলোকে নষ্ট করে দেয়। বোনটিকে বোঝানোর সময় অনেক আগে আমার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। পরিবারের আদর আহ্লাদে অভ্যস্ত আমাকে একবার খুব পছন্দের একজন মানুষের কাছ থেকে কিছু কড়া কথা শুনতে হয়েছিল। পরবর্তীতে উনি উনার আদর ভালোবাসায় আমার মনের কষ্ট দূর করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর থেকে প্রায়ই যেটা হতো উনি যখন আমার সাথে খুব আহ্লাদ করতেন, সেই কড়া কথাগুলোর কথা মনে পড়ে যেতো। এবং উনার উজার করা ভালোবাসা আমি ঠিক উজার করে গ্রহণ করতে পারতাম না ঐ মূহুর্তে। কিছুতেই বের হতে পারছিলাম না এই বেড়াজাল থেকে। একদিন ভাইয়াকে আমার এই অবস্থার কথা খুলে বললাম। কিন্তু ভাইয়া ঐ সময় তেমন কিছুই বললেন না।
কে বলেছিল কড়া কথা তোকে?
নূহা হেসে বলল, সেটা জানাটা মোটেই জরুরি না। তবে ভাইয়াকে বলার বেশ কিছুদিন পর আমার ভীষণ পছন্দের মাটন বিরিয়ানি খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে হঠাৎ মুখের মধ্যে এলাচ চলে এসেছিল। এই জিনিসটা আমি সহ্যই করতে পারিনা একদম। চিৎকার করে উঠে মুখের খাবার ফেলে দিয়ে পানি খেয়ে আবারো খাওয়াতে মনোযোগ দিলাম। ভাইয়া পাশেই বসে খাচ্ছিলেন চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন, খুব পছন্দের খাবার খাওয়ার সময় মুখে যখন খুব অপছন্দের এলাচ বা কাঁকড় চলে আসে তখন কিন্তু আমরা পুরো খাবারটা ফেলে দেইনা। বরং অপছন্দের এলাচ বা কাঁকড় ফেলে দিয়ে খাওয়া কন্টিনিউ করি। ঠিক এমনই পছন্দের বা প্রিয় মানুষেরা অসংখ্য সুখ ও আনন্দ দেবার সাথে সাথে কিছু কষ্ট, কিছু তিক্ততাও দিয়ে ফেলেন আমাদেরকে। সেজন্য কখনোই তাদের দেয়া সুখ ও আনন্দকে অবমূল্যায়ন উচিত নয়। বরং পছন্দের খাবার থেকে এলাচ বা কাঁকড় তুলে ফেলে দেবার মতোই, প্রিয়জনদের দেয়া কষ্ট বা তিক্ততা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তাদের দেয়া সুখানন্দে ভেসে চলা উচিত আমাদের। আলহামদুলিল্লাহ খুব সাধারণ একটা জিনিস থেকে সেদিন অসাধারণ একটা শিক্ষা অর্জন করেছিলাম আমি। সেই বোনটিকেও আমার অর্জিত শিক্ষাটাই বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছিলাম। আজ তোকেও বললাম। তুই না তোর ভাইজানের শূন্যতা অনুভব করছিলি? নে শুনিয়ে দিলাম তোর ভাইজানের লেকচারের কিছু অংশ।
সাফিন হেসে বলল, জাযাকিল্লাহ। ইনশাআল্লাহ আজই কথা বলবো আমি ইফতি ভাইয়ার সাথে। কিন্তু আম্মু যে বললো তোর বাসায় আজ পার্টি।
হুমম, আমাদের জুনিয়র ভগ্নী বাহিনীর সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়েছে। উনারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দল বেঁধে আমার সাথে কিছুদিন থাকবেন। আমারও যেহেতু লীভ চলছে তাই আসতে বলেছি ওদের সবাইকে। তাছাড়া মেয়েগুলো আশেপাশে থাকলে আমিও কেমন যেন ওদের বয়সী হয়ে যাই। ওদের সাথে সাথে আমিও উপভোগ করি উনিশ-কুড়ি বছরের আনন্দ উচ্ছলতা। নয়তো ওদের বয়সে আমি তিন বাচ্চার আম্মা হয়ে বসেছিলাম।
সাফিন হেসে বলল, সেজন্য বুঝি আফসোস হয় তোর?
নূহা হাসি মুখে বলল, উহু, সেজন্য কোন আফসোস হয় না। আমার আফসোসটা অন্য জায়গায়।
কোন জায়গায়?
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর নূহা বলল, ছোটবেলা থেকে আমার চারপাশের পরিবেশটাই এমন ছিল যে আমি খুবই সন্তুষ্ট চিত্ত, প্রশান্ত আত্মার একজন মানুষ ছিলাম। জীবনকে ঘিরে কখনোই আমার কোন অভিযোগ ছিল না। যেমনই ছিলাম নিজেকে নিয়ে খুশি ছিলাম। ভালোবাসতাম নিজেকে সবার চেয়ে বেশি। তাই সেই সমস্ত কাজ করা থেকে বিরত থাকতাম যাতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা অসন্তুষ হতে পারেন আমার উপর। সেই সমস্ত কাজ বেশি বেশি করার চেষ্টা করতাম যা আমাকে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে সহায়তা করবে। মানবতার বাগিচায় আগাছা হিসেবে আমার জন্ম হয়নি। আমি বহু যতনে গড়ে তোলা চারাগাছ। আমার ডালপালা যতটা না উর্দ্ধে বিস্তৃত ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত ও মজবুত ছিল আমার শেকড়। আমি বেড়ে উঠেছি একাধিক ছায়াদানকারী, সুশীতল জ্ঞানবৃক্ষের কোল ঘেঁষে। তাই জানতাম কি করছি, কেন করছি এবং এর কেমন প্রতিফল হতে পারে। যখন কারো আঘাতের বদলে আঘাত না করে ক্ষমা করে দিতাম। মনে মনে স্বস্থি বোধ করতাম নিশ্চয়ই এরফলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার কোন অন্যায়কে ক্ষমা করে দেবেন। কারো গোপন কথাকে যখন মনের কৃষ্ণগহ্বরে বিস্মৃত হয়ে যেতে দিতাম। আশা জেগে উঠতো আমার গোনাহগুলোও নিশ্চয়ই এমনি করেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দুনিয়ার সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখবেন। বড়ই বেখেয়াল আমি চলতে ফিরতে এখানে সেখানে ধাক্কা খেতেই থাকি। প্রতিটা ব্যথা পাবার মূহুর্তে উফফ উচ্চারিত হবার আগেই আলহামদুলিল্লাহ বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে এই ভেবে যে নিশ্চয়ই এই ব্যথার বদলে আল্লাহ আমার কোন ভুল মাফ করে দিয়েছেন। এমনি করে নিজের প্রতিটা কথা, কাজ ও আচরণের পেছনে যুক্তি ছিল আমার। সেই সব যুক্তি মিলিত হতো একই মোহনায়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মোহনায়। সদা সর্বদা আমার এই একটাই লক্ষ্য ছিল। মাঝে মাঝে যে ভুল হয়নি এমনটা নয়। কিন্তু ছায়াদানকারী জ্ঞানবৃক্ষরা তো ছিলেনই সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। রব্বের সন্তোষের পথে চলাটা তাই খুব বেশি কঠিন ছিল না আমার জন্য কখনোই।
এখানে আফসোসের কি আছে? সে কারো জন্যই তো এটা পরম পাওয়া।
এখানে আফসোসের কিছুই নেই। আফসোস হচ্ছে, যখন আমার ঈমানের জোর পরীক্ষার সময় এলো। আমি ভুলে গিয়েছিলাম জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেকে, আমার ছায়াদানকারী রাহবারদের দেয়া শিক্ষাকে। যারফলে আল্লাহ কতৃক তাকদীরের ভালো মন্দ নির্ধারণের পরীক্ষায় সন্তুষ্ট থাকার ব্যাপারে ভয়াবহ ভাবে অকৃতকার্য হয়েছিলাম। বুঝতে শেখার পর থেকে আমি কখনোই জীবনসঙ্গী কেমন হবে সেটা নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল মাতৃত্বকে ঘিরে। সন্তানদের তরে দুনিয়ার বুকে জান্নাত হবার স্বপ্ন লালন করা আমার কাছে স্বপ্নটা যখন বাস্তব হয়ে এসেছিল আমি সেই স্বপ্নকে পালন করতে পারিনি। ব্যর্থ হয়েছিলাম মা হিসেবেও চরম ভাবে। কষ্ট দিয়েছি সেই বাবাকে যার কাছে আমার কষ্টের চেয়ে কঠিন হয়তো কিছুই নেই জগতে। আমার জন্য উন্মুক্ত জান্নাতের দ্বার বার বার সশব্দে নিজেই বন্ধ করেছি। এতটুকুও ব্যথা মনে না নিয়ে মামণি বার বার আমার তরে খুলে দিয়েছেন জান্নাতের রুদ্ধ দ্বার। তাতেও ভুল ভাঙেনি আমার। ভুলের পথে চলা সফরটা খুব বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছে আসলে। যারফলে খুব বেশি অকৃতজ্ঞ ও অশান্ত আত্মার একজন মানুষে পরিণত হয়েছিলাম। শান্তির পথ ছেড়ে অশান্তির পথে চলেছি ইচ্ছে করে, জেদ করে। যার ফলাফল কখনোই আমার জন্য কল্ল্যাণকর হয়নি। কিন্তু তবুও থমকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যটাকে ঠিক করে নেয়ায় প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। হয়তো অনুভব করার মতো অনুভূতিই ছিল না আমার কাছে। আবেগশূন্য, অনুভূতিশূন্য বীভৎস সেই সময়ের স্মৃতিগুলো এখন আমাকে বিষধর সাপের মতোই দংশন করে। আত্মদহনের জ্বালা বড়ই অসহনীয়। মুক্তি পেতে ইচ্ছে করে এই শ্বাসরুদ্ধকর আত্মিক দীনতার কারাবাস থেকে। ছুটে যেতে ইচ্ছে করে আবারো সেই সন্তোষ ও প্রশান্ত আত্মায় আমার আমির কাছে। সত্যিকার আমার কাছে। যে আমি কোন এক ঝড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম নিজের কাছ থেকেই। তবে স্বস্থি এতটুকুই দূরে বহুদূরে হলেও এখন চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে অস্পষ্ট, আবছা মতো দেখতে পাই আমার আমিকে.. আলহামদুলিল্লাহ।
সাফিন বলল, আলহামদুলিল্লাহ। বুঝতে যখন পেরেছিস তাহলে আর অপেক্ষা কিসের? নিজের কাছে জিম্মি করে না রেখে আনন্দবাড়িতে ফিরে যা আনন্দের বাহার নিয়ে।
নূহা হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ যাবো। অবশ্যই যাবো। তবে এই মূহুর্তে আগে কিচেনে যেতে হবে। চুলায় ফিরনী দিয়ে এসেছিলাম। এতক্ষণে পুড়ে নির্ঘাৎ শেষ।
নূহাকে কিচেনের উদ্দেশ্যে ছুট লাগাতে দেখে হাসতে হাসতে সাফিন বলল, পুড়ে শেষ হয়ে গিয়ে না থাকলে আমার জন্য এক বাটি ফিরনী পাঠিয়ে দিস।

শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০১৬

খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...শেষ পর্ব




এমন আত্মমগ্ন হয়ে কি ভাবছেন?

নদীর পাড়ে বসে মৃদুমন্দ বয়ে চলা জলরাশির দিকে তাকিয়ে ছিল নূহা। স্পর্শ না করেও বহতা নদীর স্রোতের মাঝে এমন ভাবে ডুবে গিয়েছিল টেরই পায়নি কখন জাওয়াদ পাশে এসে বসেছে। প্রশ্ন শুনে জলরাশি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে জাওয়াদকে পাশে দেখে হাসি মুখে বলল, কিছু ভাবছি না তো। নদীর বয়ে চলা দেখছি।

নূহার পাশে বসতে বসতে জাওয়াদ বলল, বহতা নদীর এমন দৃশ্য দেখার পরও চুপটি করে বসে থাকার মতো অলস তো আপনার ভাবনা নয়। আমি নিশ্চিত আপনার মন নদীতে ভাবনারাও  ভাসছে শাপলা, পদ্ম রূপে।

নূহা হেসে বলল, তোমার মনেআছে আমাকে একদিন বলেছিলে আমাদের জীবনের জন্য যা কিছু কল্ল্যাণকর, এমন কিছুকে কখনোই চলে যেতে দেয়া উচিত নয়। এমন কিছুকে কখনোই স্ব ইচ্ছেয় ছেড়ে দিতে নেই। এমনটা করলে নিজেকেই ক্ষতির স্বীকার হতে হয়। জীবনের জন্য যা কিছু অকল্ল্যাণকর, তেমন সবকিছু থেকে অবশ্যই নিজেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু শুভ্রিত সুন্দর কিছুকে যদি আদায় করে নিতে হয় কখনোই দ্বিধা করা উচিত নয়। বরং সেজন্য যদি কৌশলী হতে হয়, হওয়া উচিত। নীরবতা যতই পছন্দের হোক না কেন, প্রয়োজনে সরব হতে হয়। যেখানে বলার সেখানে বলতে হয়। আমি জানি তুমি ব্যক্তি জীবনে এই কথাগুলো মেনে চলে এসেছো সবসময়ই। ভবিষতেও হয়তো মেনেই চলবে ইনশাআল্লাহ। তারপরও জানতে ইচ্ছে করছে তোমার সামনে যদি কখনো এমন কন্ডিশন আসে। যেখানে তোমাকে তোমার ব্যক্তি জীবনের সুখ-আনন্দ এবং ফ্যামিলির খুশির মধ্যে যে কোন একটাকে বেছে নিতে হয়। তাহলে তুমি কি করবে?

একটুক্ষণ সময় নিয়ে জাওয়াদ বলল, আমার ব্যক্তিগত সুখ-আনন্দের সাথে যদি সত্যিই কখনো ফ্যামিলির দুঃখ-বেদনা জড়িয়ে যায়। ইনশাআল্লাহ আমি আমার ফ্যামিলির খুশিকে বেছে নেবো। কিন্তু যদি কিছু জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতা স্বর্ত্বেও আমার এমনটা মনেহয় যে, আমার আনন্দকে অক্ষুণ্ণ রেখেও আমি ফ্যামিলিকে কষ্ট পাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবো। সেক্ষেত্রে কখনোই নিজের সুখকে ত্যাগ করবো না। কারণ জগতে সবাই সুখী হতে চায়। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নিজেকে দুঃখে নিমজ্জিত রেখে ক্রমগত অন্যদেরকে সুখী রাখা সম্ভব নয়। গাছের পাতাও তো স্থির হয়ে যায়, বাতাসের প্রবাহ ছাড়া। সেখানে মন কিভাবে সচল থাকবে কিছু প্রাপ্তির স্পর্শ ছাড়া?

হুমম...

হুমম না কারণ বলো।

কিসের কারণ?

আমাকে এমন প্রশ্ন করার কারণ।

নূহা হেসে বলল, এক ক্লাসমেট আজ চলে যাচ্ছিলো তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে। তাকে তখন ফ্যামিলির ভালোবাসার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে এমন কন্ডিশন কখনো আমার জীবনে এলে আমি কি করবো? আমি কি আমার ভালোবাসা বেছে নেবো নাকি ফ্যামিলি?

কোনটা বেছে নেবে তুমি? হাসি মুখে প্রশ্ন করলো জাওয়াদ।

এতক্ষণ সত্যিই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। কারণ আমার ভালোবাসার যে নির্দিষ্ট একটি চেহারা আছে। ভাবতে গেলে যখনই তার চেহারা ভেসে ওঠে। মনেহয় শুধু ফ্যামিলি কেন এই মানুষটির জন্য তো আমি দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে দিতে পারি।

জাওয়াদ হেসে বলল, এতো বিধ্বংসী ভালোবাসা। আল্লাহ রক্ষা করুক সবাইকে এমন ভালোবাসার কবল থেকে।

নূহা হেসে বলল, এজন্যই তো তোমার কাছে জিজ্ঞেস করলাম। গাইড লাইন পেয়েছি। এখন থেকে এভাবেই চিন্তা করবো ইনশাআল্লাহ। আচ্ছা দুজন মানুষের জীবন যদি কখনো নদীর দুই কূলের মতো হয়ে যায়, তাহলে কি করা উচিত? আইমিন, একই নদীর দুই কূল কিন্তু সর্বদাই বিপরীত দুই দিকে প্রবাহমান। তাদের নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব একই কিন্তু দুই কূল কখনোই এক হতে পারে না। অর্থাৎ, নদীর দুই কূল না একে অন্যের থেকে আলাদা হতে পারে, না কখনো একসাথে মিলতে পারে। দুজন মানুষের জীবন যদি এমন হয়? তারা একই ডোরে বাঁধা কিন্তু দুজন দু প্রান্তে। না তারা মিলতে পারছে, না একে অন্যেকে ছেড়ে যেতে পারছে। কি করা উচিত তখন?

তোমার প্রশ্নের মধ্যেই তো উত্তর রয়েছে। একাকার হওয়ার চেয়েও কিন্তু এক হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এই নদীটির কথাই ধরো। নদীর দুই কূলকে কিন্তু কেউই দুই নামে ডাকে না। দুই কূলের দুরুত্ব যতই হোক না কেন, কোনদিন তারা মিলতে নাইবা পারুক। তাতে কিন্তু কিছুই এসে যায় না। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, যত দুরুত্ব থাক আর যত যাই কিছু হোক না কেন, তাদেরকে কেউই আলাদা করতে পারবে না। একে অন্যের থেকে শত মাইল দূরে থেকেও নদীর দু কূলের নাম, পরিচয়, অস্তিত্ব একই থাকবে। মনে নেই তোমাকে আটলান্টিক মহাসাগর আর ভারত মহাসাগরের মিলনস্থান দেখিয়েছিলাম? একটা স্থানে এসে দুটা সাগর এক হয়ে গিয়েছে কিন্তু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি। পানির রঙ দেখে তাদেরকে আলাদা করা যায় খুব সহজেই। মহাসাগর দুটি পাশাপাশি একে অপরকে ছুঁয়ে থাকার পরেও উভয়ের অস্তিত্ব আলাদা, নাম ও পরিচয় আলাদা। কিন্তু ভারত কিংবা আন্টলান্টিক মহাসাগরের দুই কূলের দুরুত্ব যতই হোক না কেন, তাদের নাম ও পরিচয় কিন্তু একই। মানুষের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই ব্যাপার। মন যদি এক হয়, তাহলে শারীরিক দুরুত্বে কিছুই এসে যায় না।

নূহা হেসে বললেন, বুঝতে পেরেছি। জাযাকাল্লাহ।

কিন্তু আমি মোটেই বুঝতে পারিনি আপনি আজ এই সমস্ত প্রশ্ন কেন করছেন।

নূহা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, জগতের সবকিছু সবাইকে বুঝতেই হবে এমন কোন নিয়ম নেই।

কিন্তু তোমার উদ্ভট প্রশ্ন তো এই সংজ্ঞার আওয়ায় আসবে না। তাছাড়া বৌয়ের মতি গতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখা প্রতিটি সচেতন স্বামীর জন্য অতীব জরুরি। আর যে স্বামীর বৌয়ের মতি এমন ক্ষণে ক্ষণেই গতিপথ বদলায়। তার তো এছাড়া ভিন্ন কোন অপশনই নেই। তা না হলে সুখ পাখী দুঃখের পালক ঝরাতে ঝরাতে উড়াল দেবে।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ভালো কথা মনে পড়েছে। সকালে বারান্দায় সুখ-দুঃখ নিয়ে কি আলোচনা হচ্ছিলো তোমার আর বাবার মধ্যে? আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুধু সুখ আর দুঃখ শব্দ দুটোই শুনেছি।

ঘুমের মধ্যেও হাজবেন্ড কি বলছে, না বলছে শোনার জন্য আড়ি পাততে হবে? ঘুমের সময় তো অন্তত ছেড়ে দেয়া উচিত একজন মানুষকে।

কখনোই ছাড়বো না। এক মূহুর্তের জন্যও না। সর্বক্ষণ সিন্দাবাদের ভূতের মধ্যে তোমার মনের মধ্যে বসে থাকবো ইনশাআল্লাহ। সুখ দুঃখ নিয়ে কি বলছিলে তাড়াতাড়ি বলো এখন।

জাওয়াদ হেসে বলল, বলছিলাম জীবনের অনেক নিয়মের মধ্যে একটি হচ্ছে, জীবন কখনোই তোমাকে তোমার আকাঙ্ক্ষিত সব খুশি, সব আনন্দ একসাথে দিয়ে দেবে না। সুখের আঁচল ধরে নানান ধরণের দুঃখও হাজির হবে জীবনে। দুনিয়ার এই জগতের ধারাটাই আসলে এমন। আনন্দের কাব্য বুনে শেষ করতে না করতেই বেজে ওঠে বেদনার ডংকা! স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বটের ছায়ায় বসতে না বসতেই ঝরে পড়ে বিবর্ণ পাতা রূপে শংকা! প্রিয়জনদের সংস্পর্শে হেসে উঠে জীবন উল্লাসে, প্রিয় কাউকে হারানোর শূন্যতা পরিণত হয় দীর্ঘশ্বাসে। হঠাৎ জীবন এমন এক মোড় এসে থমকে দাঁড়ায়, মুহূর্তে পাল্টে যায় চলার পথ, পথের গন্তব্য।

হুমম...

তবে কি জানো? কষ্টের মূহুর্তগুলোর মধ্যেও ছোট ছোট আনন্দ লুকায়িত থাকে। সেইসব আনন্দ কিন্তু এমনিতে কারো কাছে ধরা দেয় না। দুঃখের প্রবাহিত স্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে চলা সুখগুলোতে আমাদেরকে খুঁজে বের করে তুলে নিয়ে হয়। তুমি আনন্দভুবনের সদস্য। তোমাকে তাই এটা শিখতে হবে।

নূহা বলল, একজন জ্ঞানী ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, সময় এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবনের প্রয়োজনে তাই সময়ই মানুষকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়। যখন প্রয়োজন হবে আমিও ইনশাআল্লাহ দুঃসময়ের উলু বন থেকে সুখের মুক্তো কুড়িয়ে নেবো। আর যদি কখনো আমি এমনটা করতে ব্যর্থ হই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাকে পথ দেখানোর জন্য ঠিক ঠিক তোমাকে পাঠিয়ে দেবেন। তুমি নানান ধরণের হুমকি ধামকি দেবে, কড়া কড়া বিষাক্ত কথা শোনাবে। কিন্তু নিঃসন্দেহে মঞ্জিলে পৌঁছানোর আগে কখনোই আমার হাত ছাড়বে না।

নূহার কথা শুনে হেসে ফেলেছিল জাওয়াদ স্বশব্দে। অতীতে বুনা আসা সুন্দর মূহুর্তের মূছর্নায় হাস্যেজ্জল হয়ে উঠেছিল বর্তমানের সময়টুকুনও। সম্মুখে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর জাওয়াদকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অতীতের মনোমুগ্ধকর এমনই কোন এক নদীর পাড়ে। কিন্তু হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে আসা একসাথে অনেকগুলো প্রিয় কন্ঠস্বরের সম্মিলিত গুঞ্জন বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে এলো জাওয়াদ। ঘুরে তাকিয়ে দেখলো ফায়েজ, আদী, রিসাব, হুমায়ূন এবং রাহাত কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। হাসি মুখে সবাইকে উদ্দেশ্যে করে সালাম দিলো জাওয়াদ।

সালামের জবাব দিয়ে আদী বলল, সবাই মিলে পিকনিকে আসার লক্ষ্যই ছিল একসাথে কিছুটা সময় কাটানো। আর তুই কিনা সবাইকে ফেলে এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস?

জাওয়াদ হেসে বলল, মাদার গ্রুপের সবাই মিলে চেপে ধরে যে পরিমাণে খাইয়েছে আজকে। ওয়ার্ক আউট করাটা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তোরা সবাই গল্প করছিলি তাই কাউকে বিরক্ত না করে একা একাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু এই জায়গাটায় এসে অজান্তেই থেমে গিয়েছিল কদম।

রিসাব হেসে বলল, জায়গাটার ভয়াবহ সৌন্দর্য নিয়ে কিছুই বলার নেই। কিন্তু আপনার কাছে প্রশ্ন আছে ভাইজান। সত্যি করে বলেন কোন বিশেষত্ব আছে এই জায়গাটার?

জাওয়াদ হেসে বলল, হুমম, আলহামদুলিল্লাহ তা আছে বলা যায়।

তাহলে এখন বিশেষত্ব বর্ণনা করে আমরা যে আপনার বিশেষ মানুষ সেটা প্রমাণিত করুন। দুষ্টুমি আর হাসি মাখা কন্ঠে বললো হুমায়ূন।

জাওয়াদ হাসি মুখে বলল, এই জায়গাটায় এসে অনেকদিন পর পেছনে ফিরে তাকানোর সাধ জেগেছিল। পেছন দিকের কিছুটা পথ হেঁটে আসার পর নতুন করে পুরোনো একটা উপলব্ধি নাড়া দিয়ে গেলো মনকে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমতের ছায়ায় জীবনের এই অব্দি সফর সুখ স্বাচ্ছন্দেই পেরিয়ে এসেছি আমরা। হ্যা ছোট বড় অনেক পরীক্ষা এসেছে জীবনে। কিন্তু সেই প্রতিটা পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হবার ব্যবস্থাও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন করে দিয়েছেন। সম্মুখেও হয়তো আরো পরীক্ষা প্রতীক্ষামাণ আমাদের জন্য। মনে প্রাণে বিশ্বাস করি অতীতের মতো ভবিষ্যতের বাঁধা-বিঘ্ন গুলোও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা দূর করে দেবেন। কিন্তু তারপরেও আমাদেরকে প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। জীবনের মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলা অব্যহত রাখতে হবে আমাদেরকে সর্বাবস্থাতে। এবং একই শিক্ষা আমাদের সন্তানদেরকেও দিতে হবে। আজকাল মাঝে মাঝে কখনো বাচ্চাদের কথায়, কখনো শব্দ প্রয়োগে, কখনো বা কন্ঠে কিছু কিছু ব্যাপারে অসন্তোষের আভাস অনুভব করি। নিজ অবস্থানে অসন্তোষ ভয়াবহ কোন জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে কোন অংশে কম নয় মনোজগতের জন্য। তাই কিছুটা শঙ্কা, কিছুটা ভীতি কাজ করছে মনের মাঝে। কেননা নিজ অবস্থানে অসন্তোষ মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিচার-বিবেচনাকে ওয়ান ট্র্যাক করে দেয়। মানুষ তখন জীবনে কি কি পায়নি সেই হিসেবের মাঝে এমন ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে, নিজের হাজারো প্রাপ্তি তাদের চোখে পরে না। মনের এই অন্ধত্বকে আমি প্রচন্ডরকম ভয় পাই। আমি চাই না আমার আশেপাশের কেউ এমন আত্মিক অন্ধত্বের শিকার হোক। যারফলে, যে রব্বের অফুরন্ত নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করতে ভুলে যাবে। কৃতজ্ঞতাকে সমস্ত উত্তম গুণাবলীর মা এর উপাধী দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ, আবেগের সাম্রাজ্যকে সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য রাজমুকুট কৃতজ্ঞতার মাথাতেই তুলে দিতে হবে। তা না হলে সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা অবশ্যম্ভাবী।

রাহাত বলল, তারমানে আমাদের সন্তানদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরো সচেতন, আরো দৃঢ় এবং আরো কৌশলী হতে হবে আমাদেরকে। এই ব্যাপারে নিশ্চয়ই আপনার কোন পরিকল্পনা আছে ভাইজান?

জাওয়াদ হেসে বলল, এই মূহুর্তে আসলে ঠিক তেমন কোন পরিকল্পনা নেই। তবে আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞ বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের অভিভাবক গণ যেভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন। আমাদেরকেও সেই পথ ধরেই চলতে হবে। জানো আমার মাঝে মাঝে ভেবে অবাক লাগে যে, আমাদের অভিভাবকগণের তো আমাদের মতো হিউম্যান সাইকোলজি, চাইল্ড সাইকোলজির ইত্যাদি সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান ছিল না। তারপরেও কি চমৎকার ভাবেই না উনারা আমাদের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ আলোকিত জীবনবোধ, পরিশুদ্ধ দর্শনের জ্ঞান এবং স্বচ্ছ ও সঠিক যুক্তির চমৎকার কম্বিনেশন আমাদের অভিভাবকগণের প্রতিজন। আর এই অনন্য, অনিন্দ্য কম্বিনেশন উনারা অর্জন করে ছিলেন কুরআন-হাদীসের সঠিক জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। সুতরাং, আমাদেরকেও তাই করতে হবে।

আদী হেসে বলল, সুখ সম্পর্কে বলা বাপীর কথাগুলো আমার যখনই মনেহয় আরেকবার করে মুগ্ধ হই। এখনো বাপীর কাছে সাইকোলজি এই জগতের সবচেয়ে বোরিং সাবজেক্ট। ত্রিশ বছর আগে হয়তো সাইকোলজির সাথে বাপীর পরিচয় শুধু এই নামে একটা সাবজেক্ট আছে এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু কত চমৎকার ভাবেই না বাপী আমাদেরকে সুখ সম্পর্কে বলতে যেয়ে বলেছিলেন, মানুষের সকল অপূর্ণতা, সকল অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তির মূল কারণ চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যের ফারাক। চাওয়া ও পাওয়ার এই বৈষম্যই মানুষকে দুঃখী করে। চাওয়া ও পাওয়ার আসলে একই ধারার প্রবাহিত হওয়াটা প্রায় অসম্ভব। কারণ মানুষের চাওয়ার কোন সীমা নেই, গন্ডি নেই। মানুষ যত পায় ততই আরো বেশি চায়। কিন্তু মানুষ যদি শুধু তার চাওয়াকে সীমিত রাখতে পারতো তাহলে হতাশা, নিরাশা, দুরাশার ঘেরাটোপে আঁটকে থাকতো না। সুখের জন্য মানুষের এই যে এত আহাজারি, হাহাকার। এই সুখ জিনিসটা তো মূলত মনের ব্যাপার। কেউ যদি মানসিক ভাবে নিজেকে সুখী ভাবে তাহলে জগতের কোন কিছুই তাকে দুঃখী করতে পারে না। আবার জীবনে কিছু অপূর্ণতা কিছু বেদনা থাকার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে সেই ব্যক্তি চির দুঃখী। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আলো-অন্ধকার নিয়েই মানুষের জীবন। তাই কোন মানুষ যদি জীবন থেকে সুখ-আনন্দ-হাসিই পেতে চায়। তাহলে বলতে হবে এরচেয়ে নির্বোধ ও অমূলক কোন চাওয়া হতেই পারে না। দিন রাত্রির পালা বদলের মতো সুখ ও দুঃখও পালাক্রমে জীবনে আসবে। আমরা কি কখনো রাতের আঁধারের মধ্যে দিনের আলোর জন্য হা হুতাশ করি? বরং উভয়ের স্বাভাবিকত্বকে মেনে নিয়ে রাতের আঁধার দূরীভূত করার জন্য নিজেরাই কোন একটা ব্যবস্থা করে নেই। এই ক্ষেত্রেও তাই করতে হবে। কষ্টকে রাখতে হবে কষ্টের জায়গায় আর সুখকে সুখের জায়গায়। সুখ-দুঃখ প্রতিদ্বন্দ্বী নয় মোটেও। বরং সহোদর। তাই সংঘর্ষ নয় সুখ ও দুঃখের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলেই সুখকে আর খুঁজে বেড়াতে হবে না। সুখই পায়ে পায়ে ঘুরবে। আসলে সুখী মানুষ হওয়া তো এই জগতের সবচেয়ে সহজ কাজ। তোমাদের যা কিছু আছে তাতে সন্তুষ্ট থাকাই হচ্ছে সুখে থাকার সবচেয়ে সহজ ফর্মুলা। মানুষ হন্যে হয়ে সুখের পেছনে ছুটে বেড়ায়। অথচ জানেই না সুখ তার হাতের মুঠোতেই বন্দী। যাপিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে খাঁজে খাঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে বাস করে সুখ পাখী।

আদীর কথা শুনতে শুনতে হাসি ফুটে উঠলো সবার মুখেই। রিসাব হাসি মুখে বলল, আসলেই কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত ও যথাযথ জ্ঞানই আমাদের বাবাদের ও মায়েদের চিন্তার জগতকে এমন উদার-উন্মুক্ত ও বিশালত্ব দান করেছিল। যারা কুরআন-হাদীস পড়ার সাথে সাথে বোঝার ও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন। তাদের সাইকোলজি, ফিলোসফি আর লজিক রপ্ত করার জন্য বাড়তি কোর্সের কোন দরকার পড়ে না। বড়আব্বুর সেই নসীহার কথা মনেআছে তোমাদের?

ফায়েজ হেসে বলল, হুম, আলহামদুলিল্লাহ। বড়আব্বু বলেছিলেন, থাকে যদি সুখী হবার গরজ, জেনে নাও সুখে থাকা খুবই সহজ। সুখের জন্য করতে হবে না আরাধনা, জানাতেও হবে না বিরাট সংবর্ধনা। যা কিছু আছে তোমার তাতেই খুঁজে নিলে সন্তুষ্টি, ইনশাআল্লাহ বারো মাসই ঝরবে সুখ নামক বৃষ্টি। শুধু যদি থাকে উপলব্ধি সুখ হাতছানি মিলবে মায়ের হাসিতে, বাবার পরামর্শে! দেখতে পাবে বোনের দুষ্টুমিতে লুকানো সুখ, সুখ ভাইয়ের সাহচর্যে, বন্ধুর পাশে থাকার মাঝেও সুখ! সুখ ভাসে ঝকঝকে নীলাকাশে, সূর্যের ঘুমে সুখ, চাঁদের প্রকাশে! নক্ষত্রের আকাশে জ্বলজ্বল করে সুখ,  মেঘের বুক থেকে বৃষ্টি রুপে ঝরে সুখ! সুখ জোনাকির টিমটিমে আলোতে, পথের কোণে ফুটে থাকা ছোট্ট ঘাসফুলেও সুখ! বাবার হাত ধরে আঁকাবাঁকা পা ফেলে হেঁটে চলা শিশুর উচ্ছ্বাসে সুখ! পরস্পরকে অবলম্বন করে সম্মুখে ধাবমান প্রবীণ দম্পতির নির্ভরতায় সুখ! বাতাসে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সুখ! বুকের ভেতর ভালোবাসার অস্তিত্বে সুখ! সুখ অভিমানে, অনুরাগে, খুনসুটি ও ত্যাগেও! বিশ্বাসে সুখ, ভরসায় সুখ, আশাতে সুখ, সুখ কিছু কিছু অপূর্ণতাতেও! জয়ে যেমন আছে সুখ, ব্যর্থতাতেও আছে সুখ নব প্রচেষ্টার। জগতের সর্বত্র ছড়ানো সুখের মেলা, তবে কেন কাটাবো  দুঃখবিলাসীতায় বেলা? কেঁদে ভাসাই সুখ বিহনে নিঃসঙ্গ একাকী, কারণ আমাদের জানাই নেই সুখ আসলে কি?

জাওয়াদ হেসে বলল, কিন্তু আমরা জানি সুখ আসলে কি! আমরা জানি কিভাবে সুখী হতে হয় আলহামদুলিল্লাহ। জানিস এই জগতে কিছু কিছু মানুষ আছেন, নতুন প্রজন্ম যাদের মাঝে  ভালোবাসার প্রকৃত সংজ্ঞা খুঁজে পায়! যারা সত্য ও সুন্দরের সমস্ত রুদ্ধ দ্বারগুলো এক এক করে উন্মুক্ত করেন তাদের পরিশুদ্ধ চিন্তার দমকা হাওয়ায়। যাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এক একটি অনবদ্য গল্প। যাদেরকে দেখে শিল্পীরাও শিখে নেয় শিল্পের নব নব কলাকৌশল! স্বপ্নচারীরা যাদের  মাঝে সন্ধান পায় কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন রাজ্যের। আমাদের অভিভাবকগণের প্রত্যেকজন ঠিক তেমন একজন মানুষ আলহামদুলিল্লাহ। চিন্তা ও কর্মে উনারা সবার চেয়ে এগিয়ে। জীবনের দূর্যোগের অঝোর শ্রাবণধারায় এমন মানুষগুলো এক মুঠো রোদ হয়ে উঁকি দিয়ে যায় বলেই আকাশ জোড়া আশার  রঙধনু ওঠে। জীবনকে এমন মানুষেরা শুধুই যাপন করতে নারাজ। অনুভব করতে চায় সময়ের প্রতিটি মূহুর্তকে। তাই জীবনের রূপ সরল হোক কিংবা জটিল, তারা দু’বাহু উন্মুক্ত করে জীবনকে বোঝার চেষ্টা করে পরিপূর্ণভাবে। অনেকসময় হয়তো দেখে মনেহয় ভীষণ আত্মভোলা এই মানুষগুলো। কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে, কেন ঘটছে সেসব ঠিকই ধরা পড়ে যায় তাদের মনের রাডারে। আর এমন মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে, জ্ঞানের উত্তাপে মোমের মতো গলে যান। তাদের জ্ঞান যেমন আলো হয়ে জ্বলতে পারে, তেমনি অথৈ পানির বুকে ভাসতে পারে। আবার  প্রয়োজনে সীলগালার কাজও করতে পারে। আরো পারে সূচালো, ধারালো এই পাথরের পৃথিবী থেকে সুখের ছোট্ট ছোট্ট নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিয়ে নিজেরা সুখী হতে এবং অন্যদেকে সুখী করতে। আমাদের সবাইকে উনাদের মতো হতে হবে। রাহবার হয়ে পথ প্রদর্শন করে গিয়ে উনাদের দায়িত্ব উনারা পালন করে গিয়েছেন। এখন সেই আলোকিত পথ ধরে এগিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের। তাহলে ইনশাআল্লাহ এই পথ ধরে আমাদের সন্তানরাও হাঁটবে তাদের সন্তানদের হাত ধরে।

আবারো সম্মিলিত হাসির রেখে ফুটে উঠলো সবার চেহারাতে। তবে সেই হাসিতে ছিল আশা জাগানিয়া দখীনা পবনের পরশে মনের স্বপ্নীল বাতায়নের কপাট উন্মুক্ত হবার পরিতৃপ্তি। দুনিয়াবী গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ সম্মুখে সত্যের আঙিনাকে উদ্ভাসিত হতে দেখার স্বস্থি। অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে ছোট্ট ছোট্ট আলোকধারী জোনাক জোনাক মানুষদের জীবনের মূল গন্তব্য হাসিলের উদ্দেশ্যে নিভৃত স্বপ্নচারী হবার প্রত্যাশা......


খুঁজে ফিরি সত্যের আঙিনা...৩০



গাছের নীচে গোল হয়ে বসে অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখা ছোট বোনদের দিকে দৃষ্টি পড়তেই হাসি ফুটে উঠলো নূহার চেহারাতে। ট্রেতে থাকা শেষ কফির মগটি নিজের জন্য তুলে নিয়ে বোনদের  কাছে রওনা হলো। সকালে যখন হঠাৎ করেই পরিবারের সবাই মিলে বনভোজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নায়লা, জুয়াইরিয়া, জুম্মি, জুনি ওরাই সবচেয়ে বেশি খুশি ছিল। সবাই মিলে কোন পিকনিক স্পটে যাওয়া হবে সেটা নিয়ে প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে বসে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেদের পছন্দের স্থান নির্বাচন করে জানিয়েও দিয়েছিল। কিন্তু যেহেতু সময়ের সল্পতা ছিল এবং ওদের পছন্দের স্পটটি বেশ দূরে ছিল, যাওয়া আসা মিলিয়ে অনেক সময় লেগে যাতো। তাই সময়, দুরুত্ব অন্যান্য সবকিছু বিবেচনা করে বাড়ি কাছাকাছি একটি জায়গাতেই আসা হয়েছে সবাই মিলে। পরিবারের বড়দের এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি হতে পারেনি জুম্মি আর তার গ্রুপ। সবাই মিলে নূহাকে এসে ধরেছিল যেন তাদের পছন্দের ব্যাপারে সুপারিশ করে। কিন্তু নিজেও সময়ের সল্পতার স্বীকার থাকার কারণে উল্টো ওদেরকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছিল নূহা। বলেছিল, কোথায় যাওয়া হচ্ছে এটা তো কোন ম্যাটার না। ম্যাটার হচ্ছে পরিবারের সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যাওয়াটা। যখন আপনজনেরা কাছে থাকেন, পাশে থাকেন তখন তো যে কোন স্থানই আনন্দভূমি। ব্যাস তাতেই হয়েছে এই হাল, অভিমানে বোনেদের ফুলেছে গাল। ওদের ইচ্ছে, চাওয়া, খুশির কোন মূল্য নেই পরিবারের বড়দের কাছে, সারাটা জীবন শুধু উনাদের মরজিই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ইত্যাদি নানান কথা বললো কিছুক্ষণ সবাই মিলে। এরপর থেকে ছয়জন এক জোট হয়ে ঘুরছে ফিরছে। বনভোজনের স্থানে আসার পর থেকেও যে ছয়জন সবার থেকে দূরে দূরে ঘুরছে সেটা খেয়াল করেছে নূহা। কিন্তু এতক্ষণ বাচ্চাদের সাথে ব্যস্ত থাকার কারণে বোনদের কাছে আসতে পারেনি।  একদম বোনদের মাঝখানে যেয়ে বসতে বসতে নূহা বলল, তোদের কেউ কি কফি পানে আগ্রহী?

জুয়াইরিয়া বলল, আগ্রহী হলেই বা কি? আমাদের ইচ্ছে, আগ্রহের কি কোন মূল্য আছে?

নূহা হেসে বলল, মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জানিস?

নায়লা বলল, আমরা জানতে চাই না।

হ্যা হ্যা একদম জানতে চাই না। তা না হলে মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা জানানোর সুযোগে তুমি আমাদের পটিয়ে ফেলবে। আজ আমরা কিছুতেই তোমার কথার ফাঁদে পড়ছি না। উহু, কিছুতেই না। দৃঢ় কন্ঠে বলল জুনি।

নূহা হাসতে হাসতে বলল, ঠিকআছে তাহলে মানুষের কথা বাদ। চল আমরা সবাই মিলে গল্প করি। অনেকদিন তোদের হালচাল জানা হয়নি। তোদেরকে বলার মতো কত কথা ফুটেছে বন বাগিচায়। চল আজ এই সুযোগটাকে কাজে লাগাই। আমাদের লাস্ট বৈঠক তিনমাস আগে হয়েছিল। তিনমাস আগের একটা মজার ঘটনা শেয়ার করবো?

ফোলানো গালের সাথে সাথে ভ্রূও খানিকটা কুঁচকে বোনেরা সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেবার পর  নূহা হেসে বলল, তিনমাস আগে আমার পুরোনো বাসা ছেড়ে বড়মামার বাড়িতে উঠেছি সেটা তো তোরা জানিসই। যেদিন বাসা বদলানো নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল সেদিন কি অনুভব করেছিলাম জানিস?

কি অনুভব করেছিলে? মুখ ভার করেই প্রশ্ন করলো নায়লা।

অনুভব করেছিলাম ঐ সময় যে বাসাটায় ছিলাম সেটা আমার কতটা পছন্দের। পছন্দ করার  অবশ্য অনেকগুলো কারণও ছিল। তোরা তো দেখেছিসই গেট দিয়ে ঢুকতেই ফুল আর পাতাবাহারের কি সুন্দর বাগান ছিল। এছাড়া খোলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দেখা যেতো সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়, তারাভরা আকাশ, জোছনার আলোতে ভেসে যাওয়া প্রকৃতি। আবার সামনেই ছিল বিশাল পার্ক তাই সবুজের সমারোহ, আর ছিল ভীষণ সুন্দর ছাদ। এদিককার বাড়িগুলো তৈরিই হয় এমনভাবে যে ছাদে উঠার  সুযোগ বেশ কম থাকে। তাই ছাদ আছে এমন বাড়ি পাওয়া সত্যিই অনেক আনন্দের। এই আনন্দ ও ভালোলাগা গুলো সবসময় অনুভব করলেও যখন জানলাম বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে অনুভবের মাত্রা বেড়ে গেলো। অবশ্য মানুষের স্বভাবটাই মনেহয় এমন। যখন কোনকিছু হারিয়ে ফেলে বা ফেলতে যায় কিংবা নিজের না জানে তখন সেটার প্রতি টান বেড়ে যায়। বেশ মন খারাপ নিয়েই গোছগাছ করলাম সবকিছু। কিন্তু জারিফকে দেখলাম ঘুরে ঘুরে সব রুমকে বিদায় জানাচ্ছে। এমনকি রান্নাঘর ও বাথরুমের কাছ থেকেও বিদায় নিলো। ওর কান্ড দেখে মজা পেয়েছিলাম খুব। সাথে সাথে অনুভবও করেছিলাম শিশুরা মনের ভেতরের অবস্থা কত সহজে প্রকাশ করে ফেলতে পারে। রাখ ঢাক করতে জানে না বলেই শিশুদের মধ্যে কোন ভাণ নেই। আমারো কষ্ট হচ্ছিলো, মনখারাপ লাগছিল কিন্তু পারিনি পুত্রের মত করে সেটা প্রকাশ করতে। আবার নতুন বাসায় যেদিন উঠলাম জারিফের সেকি খুশি। আগের বাসায় চেয়ে অনেক বড় রুম পেয়েছে নিজের জন্য। দু’হাত বাড়িয়ে মহা আনন্দে আলিঙ্গন করে নিলো নতুন বাসাকে। নিজের রুম নিজেই গোছাতে লেগে গেলো।

জুনি হাসতে হাসতে বলল, নতুন বাসায় ঢুকেই জারিফ সব রুমে রুমে ঘুরে যখন ফেরেশতাদের সালাম দিচ্ছিলো তখন আমিও ছিলাম সাথে। ওর সাথে সাথে আমিও সালাম দিয়েছি।

সবাই হেসে ফেললে নূহাও হেসে বলল, আমি কিন্তু প্রথমে কিছুতেই জারিফের মত আপন করে নিতে  পারছিলাম না নতুন বাসাটাকে। রান্নাঘরে ঢুকেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মনের পর্দায় ভেসে উঠলো আগের বাসায় সেই রান্নাঘরের ছবি। বেশ মনখারাপ নিয়েই নতুন বাসা সাজানো গোছানোর কাজ শুরু করলাম। একবার মনেহলো বাসাটা না বদলালেই ভালো হতো। মেঘাচ্ছন্ন মন নিয়েই ঘুমোতে গেলাম। পরদিন ভোরে চোখ খুলেই দেখি দূরে কি যেন একটা মিটমিট করছে। প্রথমে ভেবেছিলাম প্রভাতের তারা, পরে বুঝলাম যে আকাশের বুকে চলমান বিমানের আলো। বিছানায় শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছিলাম বহুদিন পরে। আগের বাসায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখা যেত কিন্তু বিছানায় শুয়ে এমন আকাশ দেখা যেত না। তখন হঠাৎ মনেহলো প্রতিটি জায়গা, জিনিস কিংবা মানুষের সৌন্দর্য আসলে আলাদা আলাদা। আমরা বেশির ভাগ সময়ই সৌন্দর্যের সেই বৈচিত্র্যতা খুঁজে নিতে পারিনা বা চেষ্টা করি না। কখনো ইচ্ছে তো কখনো খেয়ালের অভাবে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই হারিয়ে ফেলা কিছুর শোকে বর্তমান পাওয়াটাকে মূল্যায়ন করতে পারিনা। আর দৃষ্টি পেছনে থাকলে সামনের কিছু দেখা যাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। সামনের প্রাপ্তি যেমন দেখা যাবে না, খাদা-খন্দও দেখা যাবে না। দৃষ্টি পেছনে রেখে পথ চলার কারণে সামনে থাকা পাথরের সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পরে আমরা আহাজারি করতে থাকি "আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম"! অর্থাৎ, নিজের ভুল বা অসতর্কতার দোষ দেই ভাগ্যকে। আমরা মানুষেরা আসলেই বড় অকৃতজ্ঞ আর বেখেয়ালি। আবারো অনুভব করলাম প্রতিটা জিনিসের মাঝেই আছে কল্যান। শুধু তার রকম ও ধরণ আলাদা আলাদা। তাই মানুষ হোক আর জিনিস সবসময় খেয়াল রাখা উচিত কখনই তুলনা করা চলবে বা একটার সাথে আরেকটার। শুধুমাত্র তাহলেই হয়তো উপভোগ করা সম্ভব হয় জীবনের রঙ বদলের খেলা ও বৈচিত্র্যতাকে।

জুম্মি বলল, আমরা জানতাম তো তুমি এমন কিছুই বলবে আমাদেরকে। এজন্যই তো তোমার কথা শুনতে রাজী হইনি। এখন যেমন অপরাধী মনেহচ্ছে নিজেদেরকে।

নূহা হেসে বলল, আমি কিন্তু মোটেই তোদেরকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইনি। আমি শুধু এটা বোঝাতে চেয়েছি জীবন যখন যেভাবে আমাদের সামনে আসে সেভাবেই তাকে আপন করে নেয়া উচিত। চাওয়া পাওয়ার দ্বন্দ্ব আমাদের মনের শান্তি কখনোই বিনষ্ট করতে পারতো না, যদি আমরা যা পাচ্ছি সেটাকে মূল্যায়ন করতে পারতাম। মনের অভিমান একপাশে রেখে চিন্তা করে দেখ আজকের এই বনভোজন কি আমাদের জন্য অপ্রত্যাশিত একটি প্রাপ্তি নয়? প্রচন্ড ব্যস্ততা স্বর্ত্বেও ভাইয়ারা আমাদের সাথে বনভোজনে আসার জন্য রাজী হয়েছেন। কারণ উনাদের কাছে নিজেদের শত ব্যস্ততার চেয়েও আমাদের ইচ্ছে, খুশির প্রায়োরিটি বেশি। তাই আমাদেরও তো উচিত উনাদের সুবিধার দিকে খেয়াল রাখা। তাই না? এভাবেই তো পরিবারের সদস্যদের একে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা, ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। বন্ধন দৃঢ় হয়।

জুয়াইরিয়া বলল, আমরা বুঝতে পেরেছি আপ্পা। ভালো মতো না বুঝেই এমন বোকামী সুলভ অভিমানের জন্য আমরা খুবই লজ্জিত।

নূহা হেসে বলল, শুধু লজ্জিতই না আপনারা অনেক আনন্দ থেকেও নিজেদেরকে করেছেন বঞ্চিত। বাবা, বাপী, ভাইয়াদের কত অসাধারণ সব জ্ঞানগর্ভ কথা, দিকনির্দেশনা মিস করেছেন সেই হিসাব দিয়ে আপনাদেরকে এখন আর কাঁদাতে চাই না। তারচেয়ে পরামর্শ দিচ্ছি আর সময় নষ্ট না করে ছুট লাগান। এখনো আলোচনা চলছে নদীর পাড়ে।

নূহা কথা শেষ করার আগেই ছয়জন উঠে ছুট লাগালো। নিজ নিজ জীবন ভান্ডারের জন্য অমূল্য মণিমুক্তো সংগ্রহের লক্ষ্যে ছুটন্ত বোনদের দেখে প্রশান্তিকর হাসি ফুটে উঠলো নূহার মুখে। কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের উদ্দেশ্যে গাছে হেলান দিয়ে বসলো। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে নানান ধরণের পাতাবাহারের ঝোপের একপাশে বইয়ের খুলে ইয়াসকে বসে থাকতে দেখে বেশ অবাক হলো নূহা। যে ছেলেকে না বকে বই নিয়ে বসানো যায় না। সে কেন ঘুরতে এসে বই নিয়ে বসে আছে এই রহস্য উদঘাটনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে উঠে দাঁড়ালো নূহা। ইয়াসের কাছে পৌঁছে বলল, আমার ছোট্ট ভাইটি যে এত বড় পড়াকু সেটা তো এতদিন আমার জানাই ছিল না।  

নূহার কথা শুনে বই থেকে মুখ তুলে হেসে ফেললো ইয়াস। বই বন্ধ করে বলল, আগামীকাল আমার  ক্লাসটেস্ট আছে আপ্পা। আজ যে পিকনিকে আসা হবে সেটা তো আগে জানা ছিল না। পরীক্ষার আগেরদিন পড়া রেডি করবো ভেবে এতদিন কিছুই পড়িনি। এখন তাই অনিচ্ছা স্বর্ত্বেও আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে পড়তে হচ্ছে।

ছোট ভাইয়ের পাশে বসে হাসি মুখে নূহা বলল, এমনই হয় আসলে আমরা আজকের কাজ আগামীকালের ভয়সায় ফেলে রাখি। অথচ আগামীকাল আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে সেই সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণাও আমাদের নেই। আগামীকাল তো অনেক পরের কথা একটু পর কি ঘটতে যাচ্ছে সেটাও তো আমাদের অজানা। ভেবে দেখ সকালে নাস্তার সময়ও কি আমাদের কারো জানা ছিল আজ পরিবারের সবাই মিলে বনভোজনে আসবো?

আই এম সরি আপ্পা।

নূহা হেসে বলল, আমি কিন্তু মোটেই তোকে দুঃখিত করতে চাইনি। শুধু এইটুকু বোঝাতে চাইছি যে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা থাকা উচিত প্রতিদিনের সমস্ত কাজ প্রতিদিন সেরে ফেলার। আগামী দিনের জন্য আলসেমি করে, গাফলতি করে কাজ জমিয়ে না রাখা। কারণ আগামীকাল আমাদের জীবনে আসবে কিনা সেটাও তো অনিশ্চিত তাই না?

জ্বি আপ্পা।

একটুক্ষণ চুপ থেকে নূহা হেসে বলল, চল তোকে মজার একটা ঘটনা বলি।  দেখছিস ই তো গত কয়েকদিন থেকে আমাদের ওদিকটায় কেমন রোদ ঝলমলে আলোকোজ্জ্বল দিন। বেশ গরমও পড়ে  গিয়েছে। তাই সামারের কাপড়-চোপড় নামিয়ে ধুয়ে ছাদে নেড়ে দিয়ে এসেছিলাম গতপরশু সকালে।  বিকেল বেলা ছাদে গিয়ে কাপড় আনার কথা মনে হতেই একরাশ আলসেমি এসে মনে জড়ো হলো। ছাদে যাওয়া, ভাঁজ করে কাপড় তোলা, বাসায় আসা, আবার সবকিছু জায়গামত গুছিয়ে রাখা! নাহ! অনেক অনেক কাজ মনেহলো। ভাবলাম থাক আগামীকাল নামাবো ছাদ থেকে কাপড়-চোপড়। কিন্তু   রাতের বেলা রাহাতকে দেখলাম ছাতা হাতে বাসায় ঢুকছে। জানতে চাইলাম, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে? রাহাত  জবাবে বললো, হ্যা বেশ বৃষ্টি বাইরে। জারিফ তখন উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে জানালো, মা   আগামীকাল সারাদিন বৃষ্টি। শুধু বৃষ্টি না বিজলি চমকে চমকে বৃষ্টি।

ইয়াস হেসে বলল, তুমিও তাহলে এমন কান্ড করো।

নূহা হেসে বলল, ভুল করি বলেই তো আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডায় সংশোধনের খাজানাতে পরিণত হয়েছে। দেখিস না তোদের প্রায় সব ভুলের ব্যাপারেই লেকচার রেডি থাকে আমার কাছে। এইসবই আমার ভুলের সাধনা আলহামদুলিল্লাহ। তবে আমি কিন্তু কখনোই ভুলের জন্য আফসোস করিনা। চেষ্টা করি ভুলটাকে যতটা সম্ভব শুধরে নেবার। অবশ্য কেন ভুলটা হলো সেই বিষয়ে আবার অনেক চিন্তাভাবনা করি। যেমন পরশুরাতে মনের মধ্যে শুধু খচখচ মধ্যে করছে। কেন একটু  জোর করে গেলাম না ছাদে? তাহলেই তো শুকনো কাপড় গুলো ভিজতো না! কেন মনের অলস  ইচ্ছের কাছে নিজেকে সপে দিলাম? কেন আগামীকালের চিন্তা করে নিশ্চিন্তে বসে রইলাম? আগামীকাল কি হবে বা কি অপেক্ষা করছে সেটা তো অজানা! তাহলে কেন আগামীকালের ভরসায় আজকের করণীয়তে অবহেলা করলাম? তারপর মনেহলো আজকাল খুব করছি এই কাজটা আমি। এখন ইচ্ছে করছে না, থাক পরে করবো, আগামীকাল করবো ভেবে কাজ ফেলে রাখছি ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভবিষ্যতে যে কাজটি আমি করতে পারবো, যেভাবে ভেবে রাখছি সবকিছুই সেভাবে হবে সেই নিশ্চয়তা কোথায় পেলাম আমি??? একথা তো আমার অজানা নয় যে জীবনের কিছুই স্থায়ী নয়। যে কোন মুহুর্তে বদলে যেতে পারে জীবনের রুপ। তাহলে কেন এই অস্থায়ী এবং পর্যায়ক্রমে আবর্তিত ও পরিবর্তিত জীবনে আগামী কালকের জন্য তুলে রাখি নিজের কাজ? কেন ভুলে যাই যে আগামী কাল তো আমার জীবনে নাও আসতে পারে! কিংবা আগামী হয়তো নতুন কাজ ও দায়িত্বের বোঝা নিয়ে হাজির হবে আমার কাছে। তখন আমি নতুন কাজ করবো নাকি জমিয়ে রাখা পুরনো কাজ?! এই সম্পর্কিত রাসূল (সঃ) এর একটি হাদীস আছে। “রাসূল(সাঃ) বলেছেন, পাঁচটি বিষয়ের পূর্বে পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দেবে। এক. বার্ধক্য আসার আগে যৌবনকে। দুই. অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে। তিন. দারিদ্র আসার আগে সচ্ছলতাকে। চার. ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগে অবসর সময়কে। এবং পাঁচ. মৃত্যু আসার আগে জীবনকে”। ভেবে আমরা মুসলিমরা কতটা সৌভাগ্যবান। আমাদের করণীয়-বর্জনীয় সব সবকিছুই বলে দেয়া আছে কুরআন ও হাদিসে। কিন্তু তবুও আমরা ভেসে চলছি নফসের স্রোতে। অবহেলা করছি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে।

হ্যা আপ্পা। ইনশাআল্লাহ আজ থেকেই আমি এই ব্যাপারে সতর্ক থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।

নূহা হেসে বলল, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তোর ইচ্ছে দৃঢ় করে দিন এই দোয়া করি। আচ্ছা আর বিরক্ত না করি তোকে। মন নিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নে। আমি দেখি ফ্যামিলি কি করছে। ইয়াসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নদীর পাড়ের দিকে হাঁটতে শুরু করলো নূহা।